সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ ইজতেমার বরকতময় জুমায় শরিক হতে আসা লাখো মুসল্লির ভিড়ে মিশে হাঁটতে লাগলাম তুরাগ তীর ঘেঁষে। দুপুর ১টার মধ্যেই কহর দরিয়ার মাঠ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। নামাজ শেষে সাধারণ মুসল্লিরা যে যার মতো করে ময়দান ছেড়ে চলে গেল।
এখন ইজতেমার মাঠে যারা আছেন, যারা আসছেন তারাই আসল ইজতেমার সাথী। দুই পর্বের ইজতেমা ঘুরে একটি উপলব্ধিই আমার হয়েছে। দু’দলের মাঝেই এক মৌন প্রতিযোগিতার হয়েছে। কে বেশি লোক জড়ো করতে পারে।
মনে পড়ে গেল মাকাল ফলের কথা। বাইরে থেকে দেখতে কত হৃষ্টপুষ্ট, ভেতরে পুরোটাই ফাঁকা-তেতো। এবারের ইজতেমাও বাইরে থেকে দেখে মনে হয়েছে খুব সফল ইজতেমা; কিন্তু সার্থক হয়েছে কতটুকু দুই দলের মুরব্বিদের ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।
প্রথম দল নিজেদের পরিচয় দিয়েছে ওয়াজহাতি (স্পষ্টবাদী) বলে। দ্বিতীয় দল বলছে আমরা এতায়াতি (আনুগত্যশীল)। দুই দলের সাথীদের টুপি-দাড়ি-পাগড়ি, নামাজ-ইবাদত-বন্দেগি, খাওয়া-পরা-হাঁটাচলা কোনো কিছুতেই তো ভিন্নতা দেখিনি।
প্রথম পর্বের লোকজন যেভাবে হাসিখুশি ইজতেমা পালন করেছে, দ্বিতীয় পর্বের মানুষগুলোও একই রকম আনন্দের স্রোতে ভেসে বেড়িয়েছে। এ আনন্দ দুনিয়াবি কোনো আনন্দ নয়। এ আনন্দ হল দ্বীনের পথে থাকতে পারার অসীম আনন্দ। তাহলে ভিন্ন নামে, ভিন্ন পরিচয়ে বিভেদের উৎসবে মেতে কেন?
দুপুরের খাওয়া সেরে বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট তাঁবুতে বিশ্রাম করছি। একটু দূরে চার-পাঁচজনের একটি দল একজন মুরব্বিকে ঘিরে কথা শুনছে। ঘুম ঢুলঢুল চোখে মায়াবী সুরের কথাগুলো কানে আসছে।
তিনি বলছেন, ‘আমরা বরাবর বলে আসছি ইজতেমা হল নবীওয়ালা কাজ। সময় এসেছে আমাদের পথ-পদ্ধতি কতটুকু নবীর তরিকায় হচ্ছে তা ভেবে দেখার। আজ ইজতেমা ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গেছে। আমি ওকে ও আমাকে দেখতে পারছি না। এক আল্লাহ, এক নবী, এক কোরআনের অনুসারী হয়েও আমরা আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এ একটি কথাই প্রমাণ করে আমরা নবীর তরিকা থেকে কত দূরে সরে গেছি।
নবীজি (সা.) জীবনভর মানুষকে এক করাল, মিলে থাকার মেহনত করেছেন। তিনি আনসার-মুহাজিরদের মধ্যে ভাইয়ের সম্পর্ক গড়ে দিয়েছেন। ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমানদের নিয়ে একসঙ্গে মদিনায় ঐক্য গড়েছেন। বিশ্বের মুসলমানকে তিনি তুলনা করেছেন এক দেহের সঙ্গে। আর আজ তারই উম্মত হাজার ফেরকায় বিভক্ত। যারা নিজেদের নবীওয়ালা কাজের জিম্মাদার বলে দাবি করেন তারাও বিভক্ত।
বিকালে হাঁটতে হাঁটতে পরিচয় হল মাওলানা নুরুল্লাহর সঙ্গে। ইজতেমার বিভেদ নিয়ে যাদের হৃদয়ে অবিরত রক্ত ঝরছে তিনি তাদেরই একজন। পাঠকের কাছে এর বেশি পরিচয় না দেয়ার জোর অনুরোধ করেছেন তিনি।
প্রথম পর্বেও এসছিলেন এ ইজতেমা দরদি আলেম। চা খেতে খেতে বললেন, ‘সাংবাদিক ভাই যদি কিছু মনে না করেন দুটো কথা বলি। পারলে জাতির সামনে তুলে ধরবেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘ওয়াতাসিমু বিহাবলিল্লাহি জামিআউ ওয়ালা তাফাররাকু। তোমরা সবাই এক হয়ে আল্লাহর দ্বীনকে আঁকড়ে থাক। সাবধান! বিভেদের চর্চা করো না’- দুঃখজনক হলেও সত্য!
এবারের ইজতেমায় এ আয়াতের পুরোপুরি উল্টো আমল দেখেছি। মনজমিনে বিভেদের বীজ বুনে বাড়ি ফিরেছে লাখো সাথী। বড় আশা ছিল এবারের ইজতেমা শেষে ঐক্যের সুর বাজবে। প্রেমের সুতায় সেলাই হবে ইজতেমার তাঁবু। হায়! বিভেদের ছুরিতে স্থায়ীভাবেই কাটা হয়ে গেল ইজতেমা নামক প্রেম চাদরটি।
একই ইজতেমার মাঠে এসে ভিন্ন নাম-পরিচয় আর মনের বিভেদ আরও পোক্ত করে নিল দুই পর্বের সাথীরা। উম্মাহর ভাগ্যে, ইজতেমার ইতিহাসে এর চেয়ে বড় কলঙ্ক আর কিছুই হতে পারে না।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন মাওলানা নুরুল্লাহ। প্রতিবেদক নিজেও ঐক্যের ছেঁড়া সুতাটি জোড়ার আশায় ইজতেমা শেষে দুই পর্বেই ময়দানে ঘুরেছে। প্রথম পর্বের মিডিয়া জিম্মাদার হালের মননশীল আলেম মুফতি জহির ইবনে মুসলিম এবং দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়কারী ইজতেমার সাথী মো. সায়েমের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেছে ঐক্যের সম্ভবানা নিয়ে।
দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, দু’জনই নিজেদের মতো করে বলেছেন। মুফতি জহির ঐক্য চান তবে আলেমদের নেতৃত্বে, মো. সায়েম ঐক্য চান ইজতেমার নিয়ম মেনে। দুজনই বেশ সতর্কতার সঙ্গে কথা বলেছেন মিডিয়ার সামনে। কিন্তু ঘুরেফিরে কেন যেন বারবার ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’ গোছের কথাবার্তাই চলে আসছিল তাদের বক্তব্যে।
দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়কারী মো. সায়েম বলেন, কোনো সন্দেহ নেই ইজতেমার বিভেদ সত্যিই দুঃখজনক। হজরতজি মাওলানা সা’দ এ সংকট নিরসনের যথেষ্ট ছাড় দিয়েছেন। ঐক্য রক্ষার সব ধরনের চেষ্টা করেছেন। এখনও করে যাচ্ছেন।
কিন্তু ওয়াজহাতি দাবি করা ভাইয়েরা সমাধান তো দূরের কথা আমাদের সঙ্গে বসতেই রাজি হচ্ছে না। তাদের একটাই কথা আমাদের আকিদা খারাপ। আমাদের সঙ্গে বসা যাবে না।
যুগান্তরের মাধ্যমে ওই ভাইদের একটি প্রশ্ন করতে চাই, মাওলানা সা’দের যদি আকিদা খারাপ হয় তাহলে তাবলিগের সর্বশেষ ১৩ সদস্যবিশিষ্ট শুরা কমিটি, যা মাওলানা জুবায়েরসহ প্রণয়ন করেছেন, সেখানে দুই নম্বরে মাওলানা সা’দ এবং ১৩ নম্বরে ভাই ওয়াসিফুল ইসলামের নাম কীভাবে থাকে? আসলে আকিদা নয়, সমস্যা হল নেতৃত্ব নিয়ে…।
মাওলানা নুরুল্লাহ থেকে বিদায় নিয়ে কহর দরিয়ার পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। মাগরিবের আজানের বেশি বাকি নেই। দুপুরের টগবগে সূর্য এখন নিস্তেজ হয়ে ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। ডুবন্ত সূর্যের দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। একমনে তাকিয়ে রইলাম।
কেন জানি মনে হল সূর্য নয়, ইজতেমা নামক উম্মাহ দরদি বিশাল কিস্তিটি উল্টো মুখে ডুবে যাচ্ছে গভীর কালো সমুদ্রে….। ডুবে যাওয়া সূর্য যেমন নতুন তেজে আবার পূব আকাশে রং ছড়িয়ে পৃথিবী আলোকিত করে, ইজতেমাও একদিন ঐক্যের গান গেয়ে ইসলামের নুর ছড়াবে বিশ্বের আনাচে-কানাচে- এ আশায় বুক বেঁধে থাকলাম।
লেখক : সাংবাদিক