চলতি অর্থবছরে সরকার নির্ধারিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা এক শতাংশ কম হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, সেবা খাত এবং ব্যক্তি খাতে ভোগ বৃদ্ধির কারণে এ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
জাতীয় বাজেটে এ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৭ দশমিক ৩ শতাংশে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।
‘বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট : টারশিয়ারি এডুকেশন অ্যান্ড জব স্কিলস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে চলতি ও আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসসহ দেশের অর্থনীতির উল্লিখিত সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, এ মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে- আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করা, রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতা, রিয়েল ইফেকটিভ এক্সচেঞ্জ রেটের অ্যাপ্রিসিয়েশন। এছাড়া পলিসি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বলা হয়েছে- খেলাপি ঋণ কমানো, কর নীতি এবং প্রশাসনের সংস্কার, সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে মান রক্ষা এবং সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি রোধ করা, ডুয়িং বিজনেস পরিবেশ উন্নয়নে সংস্কার এবং চলমান সংস্কারগুলো দ্রুত কার্যকর (ব্যবসার খরচ কমানো), মানবসম্পদকে পুঁজিতে রূপান্তরের জন্য দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁয়ে বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংস্থাটির ঢাকা অফিসের সিনিয়র ইকনোমিস্ট বার্নার্ড হেভেন। এতে আরও বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির কান্ট্রি ডাইরেক্টর মার্সি মিয়াং টেমবন। উপস্থিত ছিলেন, সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুব প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার প্রশংসা করে মার্সি টেম্বন বলেন, বাংলাদেশের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অনেক উৎসাহব্যঞ্জক। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির সংখ্যা কোনো বিষয় নয়। ইতিবাচক উন্নতি এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির গতিধারাই মূল বিষয়। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেশ শক্তিশালী।
তবে এ অবস্থাকে ধরে রেখে অর্জিত প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। বাজার চাহিদা অনুযায়ী মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। গ্রামীণ অর্থনীতি ভালো করছে। তবে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য চলমান সংস্কার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা, রফতানি বহুমুখীকরণ, খেলাপি ঋণ কমিয়ে নিয়ে আনা, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় বিশেষ নজর দিতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষতা বাড়াতে ডুয়িং বিজেনেসর পরিবেশ উন্নত করতে হবে। এছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে তার মধ্যে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ শতাংশ, যা গত অর্থবছর অর্জিত হয়েছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৯ শতাংশ, যা হয়েছিল ১৩ শতাংশ। তবে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৭ শতাংশে, যা গত অর্থবছরে হয়েছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যক্তি খাতের ভোগ বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। সরকারি ভোগ ব্যয় ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৮ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে। তবে রফতানি কমার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছর পণ্য ও সেবা রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৮ শতাংশ, যা গত অর্থবছর হয়েছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি (পণ্য ও সেবা) বেড়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৮ দশমিক ১ শতাংশে, যা গত অর্থবছর হয়েছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি হতে পারে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ। বাজেটে সরকারিভাবে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। সে হিসেবে এক্ষেত্রেও লক্ষ্যের চেয়ে বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যাংক খাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ খাতটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ব্যাংক থেকে যে ঋণ দেয়া হয়, তা ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এতে সরকারি ব্যাংকগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের গ্যারান্টি দেয়ার কারণে ঋণপত্র খোলায় খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। মানব দক্ষতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, দক্ষতা ঘাটতির চ্যালেঞ্জ রয়েছে বাংলাদেশে। কলেজ ও ভোকেশনালগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে উচ্চ শিক্ষিত তৈরি হলেও তারা কাজ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে যারা কাজ দেবেন তারা যোগ্যতাসম্পন্ন লোক পাচ্ছেন না। পেশার বিপরীতে দক্ষতার ঘাটতি ব্যাপক। এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। কেননা দক্ষ বলে যারা সনদ নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে তারা প্রকৃত দক্ষ হচ্ছে না। অপর এক প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের বর্তমানে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমছে। কেননা প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এখানে মূল্যস্ফীতি বেশি। ফলে এখানে উৎপাদন খরচও বেশি। তিনি বলেন মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য স্থিতিশীল রাখার বিষয়টি ঠিক নয়।