সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ ‘জিকিরে-ফিকিরে চলি, যার যার ডানে চলি’ মধুমাখা আহ্বানে আবারও মুখরিত টঙ্গীর তুরাগ তীর। বিগত ৫০ বছরের ধারাবাহিকতায় কহর দরিয়াখ্যাত এ নদের তীরে সমাবেত হয়েছে লাখো মুসল্লি। তবে লাখো মানুষের এ ভিড়ে কিসের যেন শূন্যতা। সব থেকেও কী যেন আজ নেই।
ইজতেমা মানে একত্রিত হওয়া, জমা হওয়া। ইমানি চেতনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে তুরাগ তীরে লাখো মুসলমান একত্রিত হতেন, এক হয়ে চোখের পানি ঝরাতেন। তবে গৌরবের এ অতীত ছুড়ে ফেলে দিয়ে এ বছর থেকে আমরা এক লজ্জার ইতিহাস রচনা করছি।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও এটিই এখন সত্য, এ বছরের ইজতেমার মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাত আনুষ্ঠানিকভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল।
মত পার্থক্য গত সমস্যার কারণে বিগত তিন-চার বছর ধরেই মোবারক এ মেহনতটিতে নানা ঝামেলা চলছিল। বিশ্বব্যাপী পরিচালিত এ জামাত বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেই গত দুটি ইজতেমা যেভাবেই হোক সম্পন্ন করতে পেরেছিল। সবশেষে গত বছর কিছুটা আলাদাভাবে হলেও একই সময়ে দু’পক্ষ ইজতেমার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। কিন্তু হায়, এ বছর আমরা এ কোন নমুনা স্থাপন করতে চলেছি।
এই যে টঙ্গীর ময়দান এখন মুখরিত, দেশের সবক’টি এলাকা থেকেই এখানে মানুষ এসেছে। কিন্তু ঠিক ওই এলাকা থেকেই কিছুসংখ্যক মানুষ এখন আসেননি। তারা আগামী সপ্তাহে আসবেন আলাদাভাবে।
তুরাগ তীরের মিলনমেলায় এখন ভাঙনের সুর। কয়েক বছর আগেও বাবা-ছেলে, ভাইবন্ধু মিলেমিশে গলাগলি করে ইজতেমায় আসত। জানা নেই, চেনা নেই, এমন মানুষকেও পরম আপন ভেবে বুকে জড়িয়ে নিত; কিন্তু আজ একজন-আরেকজনের ছায়া মাড়াতেও রাজি নয়।
একই মহল্লায় থাকেন, একই মসজিদে নামাজ পড়েন, অথচ দীনি ভাইয়ের সঙ্গে এখন আর কথা হয় না। আগে একই সঙ্গে গাশতে বের হতেন, জামাতে যেতেন, আর এখন দু’জনই অপরজনকে ঠেকাতে ফন্দিফিকিরে থাকতে হয়।
মুসলমানদের কোরআন এক। নবী একজন। অথচ নবীজির (সা.) দীনের মেহনত নিয়ে আমরা ভাগ হয়ে যাচ্ছি। টঙ্গী ময়দান থেকে আগে ছড়িয়ে পড়ত সম্প্রীতির স্বপ্নিল পরশ। মত ভিন্নতা মাঝেই ছিল ঐক্যের সূর। আজ এ ময়দানে আনুষ্ঠানিকতাগুলো ঠিকই পালিত হবে, তবে তাতে থাকবে না কোনো প্রেমের ছোঁয়া।
আফসোস, এমন সময়ও আমাদের দেখতে হচ্ছে। যে তাবলিগের প্রতি আস্থা ছিল সাধারণ মুসলমানদের, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, দেশি-বিদেশি সবাই যেখানে এককাতারে চলত, তাবলিগে গিয়ে একই বাসনে খাবার খেত যারা, তারা আজ নিজেদেরই সহ্য করছে না। পরস্পর সালাম বিনিময় বন্ধ। হায়, এ কেমন কথা।
সূরা হুজুরাতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘মুমিনদের দুটি দল যদি মারামারি-বাড়াবাড়ি-বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ে, তাদের মিলিয়ে দাও…।’ তাবলিগের চলমান এ বিবাদের শুরু থেকে যুগান্তরের ইসলাম ও জীবন পাতা দু’দলকে মিলিয়ে দেয়ার এ কোরআনি নির্দেশ পালনে অতন্দ্র ভূমিকা পালন করছে।
আমাদের আহ্বান ছিল মুসলমানদের পরস্পর মতপার্থক্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতপার্থক্যের সীমারেখাও বাতলিয়ে গেছেন।
তাবলিগি মুরব্বি ও সাথী ভাইদের প্রতি আমরা মিনতি করেছিলাম, আপনারা নিজেদের স্বার্থে গত ১০০ বছরে গড়ে উঠা এ মেহনতের ভাবমূর্তিটুকু ক্ষুণ্ন করবেন না। তাবলিগ জামাতকে মানুষ শান্তিকামী দল হিসেবেই বিবেচনা করে, মানুষের আস্থার জায়গাটা যেন আপনাদের কার্যকলাপে নষ্ট না হয়, বিষয়টি আপনাদেরই লক্ষ্য রাখতে হবে।
কিন্তু সত্য প্রকাশের জন্য আজ এ কথা বলতেই হবে, তাবলিগের উভয়পক্ষের মুরব্বিরা তাদের নিজেদের মত টিকিয়ে রাখতে মোবারক এ জামাতটিকে নিজ হাতে গলা টিপে ধরেছেন। অবস্থাদৃশ্যে মনে হয়, তাবলিগের যা হোক না কেন, আমার পক্ষের মতটাই বাস্তবায়িত হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে সব নিয়মনীতি উপেক্ষিত হবে, শত বছরের ঐতিহ্য গোল্লায় যাক।
একটি মকবুল জামাতকে আমরা ব্যক্তি বা কোটারি স্বার্থে ভাগ করে ফেলেছি কী আফসোস! নিজেদের মধ্যে লড়াই করে তাবলিগ জামাতের প্রভাব প্রতিপত্তি কতটুকু বেড়েছে বা কমেছে তা তাবলিগি মুরব্বিদের গত ইজতেমা থেকে উপলব্ধির আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু না, তারা হাঁটলেন সেই বিভক্তির পথে। ধর্মীয় মোড়কে স্থাপন করলেন হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণার দেয়াল।
ভারত-পাকিস্তানের মুরব্বিদের মধ্যে যখন মতপার্থক্য দেখা দিল, তখন বিভক্তির পথে না হেঁটে সবাইকে এক করার একটি সুযোগ বাংলাদেশি মুরব্বিদের ছিল। আমাদের কাকরাইলের মুরব্বিরা যদি তখনই ভারত-পাকিস্তানের মুরব্বিদের সতর্ক করতেন যে, আপনারা মতবিরোধ করলে আমরা আপনাদের সঙ্গে নেই, তাহলে ঐক্যের একটি ভীত স্থাপিত হওয়া তেমন অসম্ভব ছিল না।
কিন্তু আমাদের বড়রাও দু’ভাগে বিভক্ত হলেন। একদল এতায়াতের নামে গো ধরলেন, আরেকদল ওয়াজাহাতের নামে মাঠে ময়দানে ছড়িয়ে পড়লেন। ফলশ্রুতিতে টঙ্গীর মাঠে মানুষ দেখল ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ইজতেমা মাঠের দখল নিয়ে লড়াই করেছে দীনের দায়িরা। ভাইয়ের হাতে রঞ্জিত হয়েছে আরেক ভাই।
দীনের নামে চালালেও এ লড়াই যে আধিপত্য বিস্তারের, তা এখন আর কারও বুঝতে বাকি নেই। এভাবে নিজেদের মধ্যে মোরগ লড়াই অব্যাহত রাখলে সামনে এটি আর বিশ্ব ইজতেমা থাকবে না, হয়ে যাবে দেশীয় বা আঞ্চলিক ইজতেমা। আল্লাহতায়ালা দয়া করে আমাদের দেশে ইজতেমার যে নেয়ামত দিয়েছেন, আমাদের জেদাজেদির কারণে তা হারাতে হলে দুর্ভাগা আমরাই হব।
তাই তো দেখা যায়, ইজতেমা নিয়ে সাধারণ মানুষেরও এখন তেমন আগ্রহ দেখায় না। এসব যে পরস্পরের দ্বন্দ্বের ফসল, তা এখনই উপলব্ধি করতে হবে। এমন বিভক্ত ইজতেমায় আখেরে কোনো পক্ষেরই লাভ হবে না। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করাটাই হবে সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত।
এবারের ইজতেমায় মধ্য দিয়ে দু’পক্ষের আলাদা পরিচিত প্রতিষ্ঠিত হলেও আমরা আশা হারাতে চাই না। বাংলাদেশের তাবলিগের দুই শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা জুবায়ের ও সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের কাছে আমরা একটি দরদি আবেদন করছি, আপনারা দু’জন অন্তত এক জায়গায় একান্তে বসুন। সব কথা বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহর ভয় ও উম্মতের করুণ পরিস্থিতির বিষয়টি আমলে নিয়ে আপনারা একটি সমাধানের চেষ্টা করুণ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা পিণ্ডি ও দিল্লির কথা বাদ দিলে নিজেদের সমাধানের পথ অবশ্যই বেরিয়ে আসবে।
এই যে তাবলিগ জামাত এখন দু’ভাগে পরিচালিত হচ্ছে, আপনারা চাইলেন কিন্তু এটি এক হয়ে যেতে পারে। ভারত-পাকিস্তানের মুরব্বিদের জানিয়ে দিন যে, আপনারা এক না হলে আমরা আপনাদের সঙ্গে নেই। একসঙ্গে আসলে আসুন, না হয় টঙ্গীর ময়দানে আমরা কাউকেই বয়ান করতে দেব না। এ চেষ্টাটা অন্তত একবার করুন, যদি আপনাদের উদ্যোগে মেহনতটা এক হয়ে যায়, তাহলে তো কোনো ক্ষতি নেই।
একটু ভেবে দেখুন, আপনাদের এসব কর্মকাণ্ডে হজরতজি ইলিয়াস (রহ.), ইউসুফ (রহ.), এনামুল হাসানসহ (রহ.) বিগত মুরব্বিরা কেমন কষ্ট পাচ্ছেন। তারা যদি কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর কাছে এর বিচার চান, আপনারা কি জবাব দিতে পারবেন?
আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবাণী ও রহমতের নিয়ামক-দাওয়াত ও তাবলিগের মহান দায়িত্ব আদায়কারী জামাতের পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে সবাইকে মুখলিসানা ভূমিকা নিতে হবে।
বিভক্ত এ ইজতেমায় দু’পক্ষ আলাদাভাবে দোয়া পরিচালনা করবেন। সবার দোয়ার ভাবভঙ্গি থাকবে এক ও অভিন্ন। পরম করুণাময়ের কাছে কায়মানোবাক্যে সাহায্য ও আশ্রয় কামনা করবে উভয় পক্ষই।
যে আল্লাহর কাছে আলাদাভাবে সাহায্য চাওয়া হবে, সেই আল্লাহ কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন- তোমরা আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূলের আনুগত্য করো, নিজেদের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করো না, অন্যথায় তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তি শেষ হয়ে যাবে, তোমরা ধৈর্য ধারণ করো; অবশ্যই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন (সূরা আনফাল-আয়াত-৪৬)।
লেখক : প্রাবন্ধিক