মা বাবার বিচ্ছেদের পর দুই বোন বেড়ে উঠেছে নিজেদের মতো করে ই । মা অন্যত্র বিয়ে করে সংসার পেতেছেন আর বাবা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড ও বাকপ্রতিবন্ধী ।
নেই মায়ের স্নেহ । নেই বাবার আদর । এমন জীবনে বেছে নেয় বোবা প্রাণী কুকুর কে । পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়িতে ফিরে একমাত্র কুকুর ই ছিলো দুই বোন পারুল ও শাহনাজের খেলার সাথী । সেই খেরার সাথী কুকুর টি মারা যাবার পর দুই বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাতের রগ কেটে ঘুমের ওষুধ খেয়ে । দুই বোন চিরকুট লিখে যায় আমাদের মৃত্যুর পর কুকুরের সাথে আমাদের কবর দিবা ! এই কুকুর আমদের ভাই ।
আড়াইহাজারে পোষা কুকুর মারা যাওয়ায় দুই বোন ঘুমের ওষুধ সেবন করে ও হাত কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় আড়াইহাজারের মুকুন্দী এলাকার একটি বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত দুই বোন হলেন- ওই এলাকার মোস্তফা মিয়ার মেয়ে পারুল আক্তার (২৩) ও শাহনাজ (২১)। মোস্তফা মিয়া ওই এলাকার পল্লী চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত।
স্থানীদের মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক হাওলাদার। সুদীর্ঘ প্রাচীর ঘেরা বাড়িতে একটি কক্ষে মেঝের বিছানায় মৃত কুকুরটিকে দেখতে পান। বিছানার চাদরে লেগে আছে রক্তের দাগ। পাশে মেঝেতে পড়ে আছে দু’টি ছুরি, কিছু ট্যাবলেটের পাতা।
ওসি বলেন, চারদিকে অন্তত সাত ফুট উচু প্রাচীরঘেরা একশ’ শতকেরও বেশি জমি। সেই প্রাচীরের উপর লোহার গ্রিল আছে আরও পাঁচ ফুট। তার মাঝখানে একটি পুরোনো দোতলা বাড়ি। ওই বাড়িতে বৃদ্ধা দাদি ও বাবার সাথে থাকতেন পারুল ও শাহানা। মা বিশ বছর পূর্বে তাদের ছেড়ে গিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। এই পরিবারটির সাথে স্থানীয় লোকজনের কোন যোগাযোগ ছিল না।
দুই কিশোরীর দাদির দেওয়া তথ্যের বরাতে আজিজুল হক বলেন, দুই বোনের একমাত্র সঙ্গী হলো দেশী জাতের একটি কুকুর। তারা আদর করে ডাকতো ‘টাইগার’। একসাথে খাওয়া থেকে শুরু করে দুইবোনের মাঝখানে কুকুরটিকে রেখে ঘুমাতেন। কয়েকদিন আগে পায়ে গুরুতর ব্যথা পায় কুকুরটি। এই আঘাতের যন্ত্রণায় দুইদিন আগে মারা যায় প্রাণীটি। মারা যাওয়ার পরও কুকুরটিকে দুইবোনের মাঝখানে শুইয়ে রাখে তারা। একজন কুকুরটিকে ফেলবে এবং অন্যজন ফেলবে না বলে।
দুই তরুণীর ঘর থেকে তিনটা চিরকুট উদ্ধার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাতে লেখা আছে, ‘আমরা দুই বোন মারা গেলে আমাদের দুইজনের কবরের সাথে টাইগারকেও (কুকুর) কবর দিও। আমাদের মৃত্যুর জন্য আমাদের দাদু বা আব্বু দোষী না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভাইয়ের (কুকুরের) সঙ্গে দুই বোনকে মাটি দিবা। ভাই আমাদের আদরের ছিল।’ এমনটিও ডায়রীতে লিখেন আত্মহননের চেষ্টাকারী দুই বোন ।
‘সমাজ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে নিসঙ্গতা থেকে এই দুই তরুণী’ আত্মহত্যা চেষ্টা করেছেন বলে ধারণা পুলিশের। এই ঘটনায় থানায় প্রাথমিকভাবে একটি সাধারণ ডায়েরির প্রস্তুতি চলছে বলে জানান আড়াইহাজার থানার ওসি।
এলাকার লোকজনের সহায়তায় শনিবার বিকেলে দুই মেয়েকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান বাবা গোলাম মোস্তফা। তাদের মধ্যে শাহানার শারীরিক অবস্থার খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়েছে বলে জানান হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া।
এদিকে খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন ওই দুই কিশোরীর মা। তার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি খবর পেয়ে হাসপাতালে আসছি। মেয়েরে আইসিইউতে নিতেছে। মেয়েদের সাথে কথা বলার আগে কিছুই বলতে পারতেছি যে কি হইছে।’ গোলাম মোস্তফা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড ও বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে যায়। তারপর থেকে মানসিকভাবে মেয়েদের যন্ত্রণা দিয়ে আসছিল। এজন্য হয়তো মেয়েরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে মনে হচ্ছে ।’
যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর বশির উল্লাহ বলেন, ‘গোলাম মোস্তফার একটা ওষুধ বিক্রির দোকান ছিল। অনেকবছর আগে ওই দোকান বন্ধ করে দেয়। অন্তত ছয় বছর আগে বাড়ির চারদিকে উচু দেয়াল দেয়। তখন থেকে তাদের সাথে আর দেখা হয়নি। ছয় বছর পর তাদের বাড়িতে আজকে ঢুকলাম। প্রতিবেশী কারও সাথেও তাদের যোগাযোগ ছিল না।’
আড়াইহাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মঞ্জুরুল মোরশেদ বলেন, ‘ডায়েরির পাশাপাশি একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। ২ মিনিট ৪২ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা গেছে, দুই বোন মারা যাওয়া কুকুরকে নিয়ে ভিডিও করেছেন। ভিডিওতে তারা বলেছেন, কুকুরটা আমাদের ভাই, সে মারা গেছে। আমরাও মারা যাবো, তিন জনকে একসঙ্গে কবর দিবা।’