সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ
তারাবির নামাজে দেখে কোরআন তিলাওয়াত করা যাবে কি না? এ বিষয়ে চার মাজহাবের ইমামদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে।
হানাফি মাজহাবের অভিমত হচ্ছে নফল ফরজ যে কোনো নামাজেই কোরআন দেখে তিলাওয়াত করলে নামাজ ভেঙ্গে যাবে। কারণ রাসুল (সা.) ও তার সাহাবিদের কেউ জীবনে কখনও দেখে কোরআন তিলাওয়াত করেননি, বা দেখে পড়ার কথা বলেননি। শাফেয়ী মাজহাবে নফল নামাজে কোরআন দেখে পড়ার অবকাশ রয়েছে। আহলে হাদিস আলেমরাও শাফেয়ী ফকিহদের মত গ্রহণ করেছেন।
এ ক্ষেত্রে একটি ঘটনা দিয়ে দলীল দিয়ে থাকেন শাফেয়ী ফকিহবিদরা। হজরত আয়শা (রা.)-এর এক গোলাম ছিলেন যাকওয়ান। যাকওয়ান কোরআন দেখে তিলাওয়াত করতেন নামাজে।
হানাফি ফকিহগণ অবশ্য এ বর্ণনাটির অন্য অর্থ করেন। আরবি ভাষায় বর্ণনাটি যেভাবে এসেছে তাতে এর দু’অর্থই করা যায়।
একভাবে দেখলে মনে হয় বর্ণনাকারী বলছেন, আয়শা (রা.)-এর গোলাম নামাজের আগে কোরআন দেখে মুখস্থ করে নামাজে দাঁড়াতেন। আরেক ব্যাখ্যায় অর্থ হয়, না, যাকওয়ান নামাজের ভেতরেই কোরআন দেখে পড়তেন।
হানাফি শাফেয়ী এই বিতর্ক অনেক পুরনো। ইসলামের মৌলিক বিষয়ে মাজহাবগুলোর মাঝে মতানৈক্য নেই। ইখতিলাফ হয়েছে শাখাগত বিষয়ে। আর এ ইখতিলাফ মেনেই আমাদের চলতে হবে।
এখন অনেকে এ ইখতিলাফ মানতে চাচ্ছেন না। তারা বলছেন হানাফি শাফেয়ী বা আহলে হাদিস বলে কিছু থাকবে না। হাজার বছর ধরে এ সব মতামত ছিল, কিন্তু এখন আমরা এ সব মতামত রাখব না।
এমন কথা বলে মূলত তারা সমাজের ভেতর বিভেদ সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। হানাফি আর আহলে হাদিস মিলিয়ে আপনি আরেকটা মাজহাব বানাবেন। তিনটা হল। এবার সেই তিনটা মিলিয়ে চতুর্থ আরেকটা বানাবে।
এভাবে শত শত পথ তৈরি হবে। এতে সমাজে বিভেদ বাড়বে ছাড়া কমবে না। যে সব মতভেদ আছে সেগুলো মেনে নিয়ে কী করে সমাজে সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করা যায় সে কথা ভাবতে হবে।
আমাদের দেশে শাফেয়ী নেই। আছে আহলে হাদিস আর হানাফি। হানাফি মাজহাব এ দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের সূচনাকাল থেকেই আছে। বখতিয়ার খিলজি বা শাহ জালাল রহ. শাসক ও সুফি সাধক উভয় ধারাই ছিল হানাফি।
কারণ বুখারা সমরকন্দ থেকে এ দেশে ইসলাম এসেছে। বুখারা সমরকন্দে হানাফি মাজহাবের প্রসার ছিল। ইমাম আবু হানিফার প্রসিদ্ধ ছাত্র ও ছাত্রদের ছাত্ররা এখানে ছিলেন।
এক-দেড়শ’ বছর ধরে আহলে হাদিসও আছে বাংলাদেশে। মূলত সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.-এর সঙ্গে ১৮৩০ সনে যে সব বিপ্লবী ছিলেন তাদের ভেতর দুটি ভাগ হয়ে যায়। একদল ঐতিহ্যের অনুসারী হানাফি। আরেক দল ছিল বিদ্রোহী। এরাই আহলে হাদিস নামে পরিচিত হয়।
সৈয়দ সাহেবের দলে এরা যুক্ত হয়েছিলেন ইয়েমেন থেকে এসে। ইয়েমেনের বিখ্যাত আলেম শাওকানির শিষ্য ছিল এরা। এদের প্রভাবে অনেক ভারতীয় আহলে হাদিস মতাদর্শ গ্রহণ করেন। এভাবে তখন থেকে উপমহাদেশে দুটি ধারা তৈরি হয়।
হানাফি ও আহলে হাদিসের ভেতর পারস্পরিক বিরোধিতা থাকলেও চরম বৈরী ভাব ছিল না কখনও। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে এই বিরোধিতা শত্রুতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যা মোটেও কাম্য নয়।
পরমত সহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই। সমাজের স্থিতিশীলতা ও স্থিরতা চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণু হতে হবে।
এখন তৃতীয় আরেক দল আমাদের সমাজে আবির্ভূত হচ্ছে। তাদের কথা হচ্ছে, আমাদের হানাফি বা আহলে হাদিস পরিচয় দেয়া যাবে না। হানাফি ও আহলে হাদিসদের যার যেটা ভালো সেটা নিয়ে আমাদের চলতে হবে। পরিচিত হতে হবে কেবল মুসলিম পরিচয়ে।
আমি হানাফিও নই আহলে হাদিসও নই আমি তো মুসলিম। মুসলিম ছাড়া কোনো দলে পরিচিত হওয়া যাবে না।
বাহ্যিকভাবে শুনতে ভালো শোনায়। কিন্তু একটু ভেবে দেখেছেন, এ লোকরা কি বলতে চাচ্ছে? এরা মূলত বলতে চাচ্ছে, যে নিজেকে আহলে হাদিস বা হানাফি পরিচয় দিলে সে মুসলিম নয়।
সমাজের সব মানুষকে কাফের বানিয়ে দিবে এরা। বাহ্যিকভাবে ভালো শোনালেও এরা মূলত অবিবেচক ফিতনাবাজ। এদের থেকে সতর্ক থাকা জরুরি।
মুসলিম হয়েও যেমন আমি বাংলাদেশি। বাংলাদেশি পরিচয় দিলে যেমন আমার মুসলিম পরিচয়ের কোনো ক্ষতি হয় না। হানাফি শাফেয়ী বা আহলে হাদিস পরিচয়ের ব্যাপারটিও ঠিক তেমনি।
শরীরের সুস্থতার জন্য যেমন চিকিৎসার কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। অ্যালোপথিক, হোমিও, আয়ুর্বেদ ও হার্বাল। আমলেরও তেমন কয়েকটি পথ তৈরি হয়েছে কোরআন-হাদিসের আলোকেই।
আবু হানিফা, শাফেয়ী, দাউদ জাহিরি নিজেদের থেকে মাসআলা বানাননি। কোরআন-হাদিস থেকেই তারা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
এভাবে অনেকগুলো পথ তৈরি হয়েছে। কোরআন-হাদিস থেকে উদ্ভূত যে কোনো পথ অনুসরণ করলেই গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব।
চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতির ভেতর সমন্বয় করতে যাওয়া বোকামি। নাপা আর হালুয়ায়ে গাউযুবানের ভেতর হোমিও কোনো ওষুধ ঢেলে নতুন আরেক ওষুধ বানাতে গেলে মানুষ পাগল বলবে। মূলত এভাবে হয় না। প্রতিটি পদ্ধতির নিজস্বতা আছে।
এ উদাহরণের মতোই একইভাবে হানাফি শাফেয়ী আর আহলে হাদিস মিলিয়ে আরেকটা পথ বানালে তা মোটেও উপকারী হবে বলে মনে হয় না।
মত-পথ না বাড়িয়ে আমাদের যা প্রয়োজন তা হচ্ছে যে সব মাজহাব আছে সেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে পরস্পর সহাবস্থানের চিন্তা করা। এ ছাড়া বর্তমান দুনিয়ার পরস্পরবিরোধী মুসলিমদের মাঝের দূরত্ব দূর করা সম্ভব হবে না।