সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ আত্মশুদ্ধি, ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ, মাগফিরাত ও মুসলমানদের নিরাপত্তা চেয়ে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রোববার শেষ হল দাওয়াতে তাবলিগের ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা। দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরুব্বি মাওলানা জামশেদ।
বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে শুরু হয়ে মোনাজাত শেষ হয় ১২টা ৬ মিনিটে। ১৭ মিনিটের এ মোনাজাতের প্রথম পাঁচ মিনিট মাওলানা জামশেদ আল কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো পাঠ করেন। পরের সময়টুকুতে উর্দু ভাষায় তিনি কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে আরজি জানান। এ সময় আমিন আমিন ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে তুরাগতীর।
দেশের ৬৪ জেলার কয়েক লাখ মুসল্লি ও বিশ্বের ৫৯ দেশের ৩ হাজার ৪২৪ মুসল্লি বিশ্ব ইজতেমার এ পর্বে (দ্বিতীয়) অংশ নেন। এরা ছাড়াও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ভোর থেকেই ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার আরও কয়েক লাখ মানুষ ছুটে আসেন। মুঠোফোন, রেডিও ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাধে দেশ-বিদেশের আরও বহু মানুষ একই সঙ্গে হাত তুলেছেন পরওয়ারদিগারের শাহি দরবারে।
আখেরি মোনাজাতে শরিক হন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আনোয়ার হোসেন, জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম, গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিনুর ইসলাম প্রমুখ। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য (সাবেক ও বর্তমান) সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, শাহরিয়ার নাফিস, জুনায়েদ সিদ্দিকী, সোহরাওয়ার্দী শুভ, রাকিবুল হাসান ও নুরুল হাসান সোহান অংশ নেন মোনাজাতে।
আখেরি মোনাজাত শেষে একসঙ্গে এত মানুষ ফিরতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন মুসল্লিরা। যানবাহন সংকটে অধিকাংশ মুসল্লিই হেঁটে বাড়ির পথ ধরেন। যারা যানবাহন পেয়েছেন তাদের গুনতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া।
ময়দানের গণমাধ্যম সমন্বয়কারী মো. সায়েম বলেন, রোববার দুপুর পর্যন্ত ময়দান থেকে দেশি-বিদেশি প্রায় ২ হাজার ৫০০ জামাত দাওয়াতি কাজে বেরিয়ে গেছে। দেশে-বিদেশে দাওয়াতি মেহনত করবে তারা।
আখেরি মোনাজাত শেষে আগামী বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করেছেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা সাদ আহমদ কান্ধলভী অনুসারীরা। দ্বিতীয় পর্বের আয়োজকদের অন্যতম মুরুব্বি হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমরা আগামীতে দুই পর্বে ইজতেমা করব। প্রথমপর্ব ২৫-২৭ ডিসেম্বর এবং দ্বিতীয় পর্ব আগামী বছরের ১-৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ১৩-১৭ নভেম্বর ইজতেমা ময়দানে পাঁচ দিনের জোড় অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে (প্রথম পর্বে) শূরায়ি নেজামের অনুসারীরাও দুই ধাপে বিশ্ব ইজতেমার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা জানিয়েছিলেন, আগামী বছরের ৮-১০ জানুয়ারি প্রথম ধাপ এবং ১৫-১৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ২৭ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
মুসল্লিদের ঢল : ভোর ৪টা থেকে টঙ্গীমুখী সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় দীর্ঘ পথ হেঁটে টঙ্গী পৌঁছতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। সড়ক-মহাসড়ক, নদী ও রেলপথে টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষের ঢল নামে। ময়দানে জায়গা না পেয়ে সড়ক-মহাসড়ক, আশপাশের বাসাবাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদ ও করিডোর, এমনকি গাছতলায়-যে যেখানে পারেন জায়নামাজ, খবরের কাগজ, পলিথিন বিছিয়ে বসে পড়েন। বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে মোনাজাত শুরু হলে দাঁড়িয়ে বা বসে তারা হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে।
এবার পুরুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী নারীকেও কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে টঙ্গী এসে মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা গেছে। এদের অনেকের পোশাক নিয়ে (বোরকা-হিজাব না থাকা) বিব্রত অবস্থায় পড়েন অন্য মুসল্লিরা। আখেরি মোনাজাতের জন্য রোববার আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল অলিখিত ছুটি।
হেদায়েতি ও সমাপনী বয়ান : আখেরি মোনাজাতের আগে নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরুব্বি মাওলানা জামশেদ দীর্ঘ বয়ান করেন। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাস্তায় বের হব, আর আমাকে শহীদ করে দেয়া হবে, আমি আবারও আল্লাহর কাছে জীবন চাইব এবং আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে শহীদ হয়ে যাব।’- এভাবে নবী করিম (স.) আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে একবার-দুবার নয়, সাতবার শহীদ হওয়ার কথা বলেছেন। আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে যে গায়ে ধুলাবালি লাগবে, সেই শরীর জাহান্নাম তো দূরের কথা জাহান্নামের ধোঁয়া পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারবে না।
মোনাজাতে যা বলা হল : মাওলানা জামশেদ মোনাজাতে বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের গুনাহকে মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, আমাদেরকে ইমানের হাকিকত ও কামাল নসিব করে দেন। হে আল্লাহ, আমাদেরকে ইমানি জিন্দেগি নসিব করে দেন। হে আল্লাহ, সারা জীবন যেন আপনার হাবিবের সুন্নতের ওপর চলতে পারি সেই তৌফিক দান করেন। হে আল্লাহ, সব মুসলমানের ইমান-আমল, জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুকে হেফাজত করেন। হে আল্লাহ, দাওয়াতের কাজকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেন। হে আল্লাহ, সব ধরনের ফেতনা থেকে আমাদের হেফাজত করেন। হে আল্লাহ, বাতিলের সব রাস্তাকে বন্ধ করে দেন। হে আল্লাহ, হকের সব রাস্তাকে খুলে দেন। হে আল্লাহ, হকওয়ালাদের রহমত করেন।
বিদেশি মেহমান : মুরুব্বি প্রকৌশলী শাহ মো. মুহিবুল্লাহ জানান, আরবি ভাষাভাষী ৯৯ জন, উর্দু ভাষাভাষী ১ হাজার ৪০ জন, ইংরেজি ভাষাভাষী ১ হাজার ১৭২ জনসহ ৫৯ দেশের ৩ হাজার ৪২৪ জন বিদেশি মেহমান দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সোমালিয়া, ইরান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বেশি মেহমান এসেছেন।
আরও দুই মুসল্লির মৃত্যু : শনিবার বিকাল থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত আরও দুই মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন : নোয়াখালীর হাতিয়া থানার আজিমনগর গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে মনির উদ্দিন (৪০) ও গাইবান্ধার গোবিন্দপুর থানার চাঁদপাড়া গ্রামের মজিবুর রহমানের ছেলে শাহ আলম (৫৫)। এ নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে ৯ মুসল্লির মৃত্যু হল। প্রথম পর্বে ইন্তেকাল করেন ১৩ মুসল্লি।
মাওলানা সা’দকে নিয়েই ইজতেমা করতে চান অনুসারীরা : যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে শনিবার রাতে ইজতেমা ময়দানে মতবিনিময় করেন চট্টগ্রামের লালখান জমিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমীর মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, আশা করি মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে নিয়ে যে বিরোধ তা আগামী বিশ্ব ইজতেমার আগেই নিরসন হবে। আগামী ইজতেমায় মাওলানা সাদের আসার পথ তৈরি হয়ে যাবে।
মিডিয়া সমন্বয়কারী মো. সায়েম জানান, আমাদের মতানৈক্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। ধীরে ধীরে বিদেশি মুসল্লি আসা কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এটি আর বিশ্ব ইজতেমা থাকবে না। তখন এটি বাংলাদেশের ইজতেমায় পরিণত হবে। আগে যেখানে শতাধিক দেশ থেকে ২৫-৩০ হাজার বিদেশি মুসল্লি আসতেন, এবার দুই পর্বে এসেছেন মাত্র ছয় হাজারের মতো। তাই ঐক্যবদ্ধ ইজতেমা খুব জরুরি।