সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ হিজড়া আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাতের এক অনন্য মানব সম্প্রদায়। এ মানব সম্প্রদায় সম্পর্কে আমাদের মন-মগজে এক ভিন্ন নেতিবাচক বদ্ধ ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। ফলে সমাজে অতি কাছে থেকেও হিজড়াদের সম্পর্কে আমাদের দায়িত্ববোধের অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।
প্রতিবন্ধী মানুষের যেমন শারীরিক ত্রুটি থাকে এটি তেমনই একটি ত্রুটি। তবে এই ত্রুটির জন্য তাদেরকে মানব সমাজ থেকে বের করে দেয়া ঠিক না। বরং অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মত তারা আরো বেশি স্নেহ মমতা ও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখে।
হিজড়াদের প্রতি ঘৃণা নয়, ভালোবাসা -স্নেহ এবং গুরুত্ববোধ দরকার। গুরুত্বহীনতায় সমাজের যেকোন মানুষ ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্নবাদীতে পরিণত হয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলা একাডেমীর সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান বলছে, ‘হিজড়া’ শব্দটি হিন্দি ভাষা থেকে এসেছে। হিজড়া বিষয়ক একজন গবেষক বলেন, হিজড়া শব্দটি এসেছে ফার্সি থেকে। ফার্সি ভাষায় হিজড়া অর্থ হল ‘সম্মানিত ব্যক্তি’।
হিজড়া প্রকৃতপক্ষে নারী-পুরুষের বাইরে আল্লাহর সৃষ্টি আরেকটি লিঙ্গ বৈচিত্রের মানবধারা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজিদে বলেন, তিনি আল্লাহ মাতৃগর্ভে তোমাদেরকে যেমন ইচ্ছা তেমন রূপ দেন…(আল ইমরান-৬)।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা এবং সম্পদ দেখেন না বরং তিনি তোমাদের হৃদয় এবং আমলসমূহ দেখেন। ( সহি মুসলিম -৬৭০৮)
যৌন বৈচিত্রের ভিত্তিতে পৃথিবীতে মোট চার ধরনের হিজড়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
ক. পুরুষ (তবে নারীর বেশে চলে) তাদের আকুয়া বলে। এরা মেয়েদের বিয়ে করতে পারে।
খ. নারী (বেশেও তাই, তবে দাড়ি মোঁচ আছে) তাদের জেনানা বলে। তারা পুরুষের কাছে বিয়ে বসতে পারে।
গ. লিঙ্গহীন (বেশে যাই হোক) তাদের খুনসায়ে মুশকিলা বলে। এরা কারা সে বিষয়ে বিজ্ঞ চিকিৎসক সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
. কৃত্রিমভাবে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে বানানো হিজড়া। তাদের খোঁজা বলে। যৌন অক্ষমতার দরুন তারা বিয়ে করতে পারে না। হিজড়া মানব বিশেষ লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়। তাদের লিঙ্গ অনুপযোগী ,কোন কোন ক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ।
ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী হিজড়া বলা হয়, যার পুরুষ লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ উভয়টি রয়েছে অথবা কোনটিই নেই। মূত্রত্যাগের জন্য একটি ছিদ্রপথ রয়েছে।একই দেহে স্ত্রী ও পুরুষ চিহ্নযুক্ত অথবা উভয় চিহ্নবিযুক্ত আল্লাহর সৃষ্টি মানুষটি হলো হিজড়া।
সৃষ্টিগতভাবে সব মানুষই নিখুঁত নয়।কারো হাত নেই ,কারো পা নেই, কেউ চোখে কম দেখে, কেউ কানে কম শোনে, কেউ কথা বলতে পারেনা ,কারো বুদ্ধি কম, তবু এরা সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি।
এদেরকে আমরা প্রতিবন্ধী বলি। কিন্তু অবহেলায় ফেলে দেয় না। বরং বেশি আন্তরিক হই। যেমন, এদের জন্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্ধ হাফিজিয়া মাদ্রাসা, বধির- প্রতিবন্ধী স্কুল। অপরদিকে ধর্মীয় দায়ীদের পক্ষ থেকে চলছে বোবাদেরকে নিয়ে তাবলীগ জামাতের জোর মেহনত।
ফলশ্রুতিতে সমাজের এসকল প্রতিবন্ধী ইসলামের আলোয় নিজেকে আলোকিত করার নতুন দিগন্ত পেয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের সফল মানুষ হবার প্রয়াসী হচ্ছে। যেহেতু হিজড়ারাও এক ধরনের প্রতিবন্ধী, ইসলামের সকল হুকুম-আহকাম জানার -মানার অধিকার ও দায়িত্ব তাদেরও রয়েছে।
ইসলাম হিজড়াদেরকে গুরুত্বহীন মনে করেনা বিধায় ইসলামী শরীয়ত মিরাছ তথা সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য পরিস্কার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
ইসলামি শরীয়া অনুযায়ী হিজড়া সন্তান তারা মা- বাবার সম্পত্তির ভাগ পাবে। এবং উত্তরাধিকার সম্পদে তারা নারী হিসেবে পাবে নাকি পুরুষ হিসেবে পাবে সেটা ইসলামী শরীয়াত নিশ্চিত করেছে।যে হিজড়া নারী বা পুরুষ প্রকৃতির সে নারী বা পুরুষের মানদণ্ডে উত্তরাধিকার সম্পদ পাবে।আর যে নারী নাকি পুরুষ এর কোনটিই চিহ্নিত করা যায়না সে তার প্রসাবের পথের অবস্থা অনুযায়ী ভাগ পাবে। (সূত্র সুনানে বায়হাকী, হাদিস নং ১২৯৪)।
নপুংসক অর্থ ধরে কাউকে হিজড়া বলে গালি দেয়া যাবে না। কাউকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। (পবিত্র কোরআন ,সূরা হুজুরাত, আয়াত ১১)।
মনে রাখতে হবে যারা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী তারা আমাদের সভ্য সমাজেরই কারো না কারো সন্তান।আগে আমাদের দেশে শারীরিক অন্য প্রতিবন্ধীদের বোঝা মনে করা হতো। এখন তারা গৌরবের এবং মর্যাদার সঙ্গে বড় হচ্ছে। লিঙ্গ প্রতিবন্ধীরা ঠিক এমনই একটি ধারা। তাদেরও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে দিতে হবে।
পরিবারের অন্য সদস্যদের মতই তারাও বড় হবে, শিক্ষা লাভ করবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।
সংবাদপত্র সূত্র অনুযায়ী সারাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা ৫০হাজারের মতো। এতো সামান্য হিজড়াদের জন্য প্রয়োজনে অন্ধ হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও প্রতিবন্ধী স্কুলের মত তাদের জন্যও প্রতিষ্ঠা করা হোক স্বতন্ত্র মাদ্রাসা ও স্কুল।যাতে তারাও অন্য সবার মতো হাফেজ, আলেম ও দেশের সুশিক্ষিত নাগরিক হয়ে উভয় জগতে সফলতা পেতে পারে।
তাদেরকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে সমাজের লজ্জার কিছু নেই। ঠুনকো সামাজিক লজ্জার বৃত্ত ভেঙেই তাদের পিছনে শুরু হোক উভয় জাহানের মুক্তির হেদায়েতের ধারাবাহিক মেহনত। লাগাতার মেহনত ও ফিকির করলে বোবা জামাতের মত তাদের মাঝেও তৈরি হবে ইসলাম জানা ও মানার অদম্য স্পৃহা। আর এভাবে তাদের ভিতরেও সৃষ্টি হতে পারে যোগ্য হাফেজ, মুহাক্কিক আলেম, এবং দায়ী ইলাল্লাহ।
আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আরব ভূমিতে আগমন করেন তখন আরবের ঘরগুলোতে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়া লজ্জার ছিল।কিন্তু ইসলাম যখন কন্যা সন্তানের মর্যাদা ঘোষণা করল তখন নারী হয়ে উঠল সমাজের মর্যাদাশীল। লিঙ্গ প্রতিবন্ধীতা নিয়ে জন্মানোয় লজ্জার কিছু নেই। তাকে সুস্থ ভাবে লালন- পালন করাই হবে গৌরবের বিষয়।
২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের সামাজিক স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ সাল থেকেই বাংলাদেশ হিজড়ারা ভোটার। তাদের এই রাজনৈতিক অধিকার রাষ্ট্র মেনে নিয়েছে। আমাদের দেশে তাই নারী আছে পুরুষ আছে এবং তৃতীয় লিঙ্গ আছে এটা আমাদের গৌরব।
হিজড়ারা কেন নারীরূপে সাজতে ভালোবাসে
প্রকৃতপক্ষে মানবপ্রকৃতির সবাই সাজতে ভালোবাসে। মেয়েরা একটু বেশি সেজে থাকে।হিজড়া নারী-পুরুষ যাইহোক সবাই দল ধরে সাজতে ভালোবাসে।এমনিতে হিজড়াদের একটা অংশ ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজি ,ছিনতাই ,বকশিশ তোলা ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত আছে।
এই কাজগুলো নারী সেজে করলে সুবিধা বেশি হয়ে থাকে তাই তাদের মনে একটা সুবিধাবাদ কাজ করে।যেহেতু আমাদের দেশের নারীরা এসব বৃত্তি ও পেশা সাধারণত বেছে নেয়না তাই হিজড়ারা এই সুযোগটাকে গ্রহণ করে। এতে প্রকৃতপক্ষে আমার আপনার মা-বোন স্ত্রী তথা গোটা নারী সমাজ অপমানিত হয়।
হিজড়াদের নিয়ে নেতিবাচক মানসিকতা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ। অপরদিকে এইসব প্রতারণামূলক ঘৃণিত কাজ পছন্দ করে না এমন হিজড়া তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। হয়তো দায় পড়ে জোর করে এসব করতে হয়। অপরদিকে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত হিজড়ারা এসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
বাংলাদেশ সরকার একটি সুন্দর হিজড়া সমাজ গড়ে তোলার জন্য নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ অধিদফতর ২০১২ সাল থেকে হিজড়া শিশুদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করেছে। বাংলাদেশ আইন কমিশন সুপারিশকৃত বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪ প্রণয়ন করেছে। জাতীয় সংসদে তা গুরুত্ব পেয়েছে।
মনে রাখতে হবে তারা নারী না পুরুষ এ প্রশ্নের উত্তরের চেয়েও জরুরি হলো তারা মানুষ। সুতরাং ইসলামের সব মৌলিক অধিকার তাদের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়া একজন আলেমের নৈতিক ও ঈমানি দায়িত্ব।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিজড়াদের জন্য পঞ্চাশের বেশি বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন রয়েছে। এবং তাদের রয়েছে নানা রকম প্রকল্প ও কর্মসূচি। সরকারি উদ্যোগের সাথে মিলে এসব সংস্থা ও সংগঠন বাস্তবসম্মত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ তিক্ত হলেও সত্য,ইসলামের শিক্ষা তাদের কাছে আমরা কতটা পৌঁছাতে পেরেছি এ বিষয়টি চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
নামাজ, রোজা, পর্দা ইত্যাদি সবকিছু লিঙ্গ অনুসারে করবে।তাদেরকে আগলে রাখলে তারা হিংস্র হয়ে উঠত না, চাঁদাবাজি করত না। হিজড়ারা যাতে সাধারণ মানুষের উপর জুলুম না করে সেজন্য তাদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শ শিক্ষা দিতে হবে ।এবং তাদেরকে গুরুত্ব দিলে এসব কর্মসূচি দ্রুত ফলপ্রসূ হবে বলে আশা করা যায়, ইনশাআল্লাহ।
অতএব ইসলামী মূল্যবোধ এবং সুমহান আদর্শের আলোকে এটাই প্রমাণিত লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের এ পরিমাণ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে যে পরিমাণ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে একজন সুস্থ-সবল মুসলিমের। ইসলামী শরীয়াতে একজন মুমিন মুত্তাকী হিজড়া শত সহস্ত্র কাফের নারী-পুরুষ ফাসেক ও মুত্তাকি নয় এমন মুসলিম অপেক্ষা উত্তম।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সমাজের একটি অংশ স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে হিজড়া বৃত্তির দিকে ঝুকে পড়ছে।এরা যখন দেখলো হিজড়া বৃত্তিতে সহজে ভাল উপার্জন হয় তখন বেছে নিতে শুরু করলো নকল হিজড়াবৃত্তির ঘৃণ্য এ পথ। অন্ধকার এ জগতের নিয়ন্ত্রক একদল কুচক্রী।
তাদের চক্রান্তের ক্রীড়নক কতগুলো সুস্থ মানুষ।এরা সুস্থ শিশু অপহরণ করে পেনিস অপসারণ করে কিংবা ওষুধ খাইয়ে হিজড়া বানায়।অনেকে আবার নানা প্রলোভনে এ জগতে এসে ফেঁসে গিয়েছে। এখন বেরিয়ে আসার মুক্তির পথ খুঁজছে। ইসলাম তাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানায়।
যারা ইচ্ছাকৃত এমন করে তাদের ব্যাপারে হাদিসে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: রাসুল ঐসকল নারী-পুরুষদের লানত করেছেন যারা একে অপরের সাদৃশ্য অবলম্বন করে ।[বুখারী হাদিস নং ৩৮৮৫]।
তারাও সম্মানিত মানুষ এ অনুভূতি যদি তাদের মধ্যে জাগ্রত করা যায় তাহলে সুনাগরিক ও দ্বীনদার মানুষ হিসেবে তাদেরকে গড়ে তোলা খুবই সহজে সম্ভব হবে। বিষয়টি কঠিন হলেও পন্ডশ্রম হবে না কিছুতেই ইনশাআল্লাহ।
সমাজের অবহেলিত এই তৃতীয় লিঙ্গের কর্ণকুহরে এবং দিল দুয়ারে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার এ মহান মেহনতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে কবুল করুন।