সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ
মানুষ হিসেবে একে অন্যের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকা স্বাভাবিক। এসব মানবিক গুণাবলি মানুষের মাঝে আছে বলেই পৃথিবী এখনও টিকে আছে।
আর মানবীয় গুণাবলি বিকাশে ও উত্তম মনুষ্য চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন বা সুকুমারবৃত্তি অর্জনের মূলেও আছে বিশ্বাস, আশা, ভালোবাসা। সৃষ্টিকুল কায়েনাতও ভালোবাসার ফল।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর কুদরতের মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি আছে।’ (সুরা রুম, আয়াত: ২১)
ভালোবাসা হলো খোদায়ি অনুভূতি, আত্মার তৃপ্তি, মনের প্রশান্তি। তবে এ ভালোবাসারও সীমারেখা আছে।
মুসলমান হিসেবে সর্বাধিক ভালোবাসা আল্লাহ ও রাসূলের জন্য হতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ ও তার রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের পরিবার, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতে মন্দা পড়ার আশঙ্কা করো এবং তোমাদের আবাসস্থল যা তোমরা ভালোবাসো, তাহলে আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো, আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সত্য পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ২৪)
ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও উত্তম চরিত্রমাধুর্য দ্বারা আমাদের নবীজী মুহাম্মদ (সা.) জয় করে নিয়েছেন শত কোটি মানুষের হৃদয়। বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন ইসলামের বাণী।
মুসলমানদের কাছে ভালোবাসার কোন দিবস নেই, প্রতিটি দিন তাদের কাছে প্রেমময়-ভালোবাসাময়।
কিন্তু যেসব মুসলমান ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করে তাদের কাছে ভালোবাসা নিদারুণ যন্ত্রণা, জটিলতা, সংকট ও নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন।
তারা ভালোবাসার মানুষকে পোশাকের মতো পরিবর্তন করে নতুন সঙ্গীর সন্ধানে অস্থির থাকে।
হতাশার কথা হলো, ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ নামে ব্যাপক উদ্দীপনার সঙ্গে আমাদের দেশেও এখন ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ পালিত হয়।
মূলত যে দিবসটি ছিল প্রাচীন ইউরোপীয় গ্রিক-রোমান পৌত্তলিকদের একটি ধর্মীয় দিবস। এর সূচনা মধ্যযুগে হলেও নব্বই দশকের শুরু থেকে বিশ্বব্যাপী এর প্রসার ঘটে।
আশির দশকেও বাংলাদেশের মানুষ এ দিবসটির সঙ্গে ছিল অনেকটা অপরিচিত। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সহযোগিতায় ও মিডিয়ার কল্যাণে এ দেশের যুবসমাজের মাঝে তা ছড়িয়ে পড়ে।
ভালোবাসা দিবসের উৎস নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে যদ্দুর জানা যায়, লুপারকালিয়া নামে প্রাচীন রোমে এক উৎসব ছিল, যা ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অবধি হতো।
যে উৎসবে নারী-পুরুষ সমানতালে মদ পান করতো এবং লটারির মাধ্যমে সঙ্গী বেছে নিয়ে তার সঙ্গে একান্তে মিলিত হতো।
অত:পর রোমানরা যখন তাদের প্রাচীন ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে ধাবিত হচ্ছিল, তখন তারা প্রাচীন দেবীর নামে লুপারকালিয়া উৎসবকে মেনে নিতে পারছিল না।
আবার উৎসবটি খুব জনপ্রিয় ছিল বলে ছেড়েও দিতে পারছিল না। অবশেষে উৎসবটিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে উৎসর্গ করে উদযাপন করত।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নোয়েল লেন্সকি বলেছেন, লুপারকালিয়া উৎসবে পুরুষরা দেবী লুপারকাসের নামে একটি ছাগল আর একটি কুকুর বলি দিত। তারপর মৃত ছাগল বা কুকুরের চামড়া দিয়ে উৎসবে অংশগ্রহণকারী মেয়েদের বেদম প্রহার করতো।
তাদের বিশ্বাস, এ প্রহারের কারণে মেয়েদের প্রজননক্ষমতা বাড়ে।
ভালোবাসা দিবসের সূচনা ইতিহাস সম্পর্কে আরও যা জানা যায়, ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিবাহিত পুরুষদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ করে দেন এবং আইন জারি করেন, তার সাম্রাজ্যে কেউ বিয়ে করতে পারবে না।
কারণ বিবাহিত সেনারা স্ত্রী-সন্তানদের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে চাইত না। কিন্তু রোমান এক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের ন্যায়ভ্রষ্ট নিয়মের প্রতিবাদ করেন এবং বিয়ে করেন।
এ খবর সম্রাট ক্লডিয়াসের কাছে পৌঁছলে তিনি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেন। আর সে মৃত্যুদণ্ডটি কার্যকর হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি।
ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ দিবসকে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
আবার কারও কারও মতে, ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন খ্রিস্টান পাদ্রি ও চিকিৎসক। সে সময় রোমানরা ছিল দেব-দেবীর অনুসারী।
২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অভিযোগে ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বন্দী অবস্থাতেই ভ্যালেন্টাইন জেলারের অন্ধ মেয়ের চোখের চিকিৎসা করেন। ফলে মেয়েটি তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ভ্যালেন্টাইন মেয়েটিকে লিখে যান, , Love From your valentine আর এ ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।
প্রকৃত ভালোবাসা তো মানুষের মানবীয় মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে, হৃদয়কে প্রশস্ত ও প্রশান্ত করে, যা কল্যাণময় সমাজ ও সভ্যতার বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে।
সংঘাতময় এ পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য করার জন্য এ ভালোবাসার প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কতই না প্রয়োজন!
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের’ নামে শুধু যুবক-যুবতিদের জৈবিক ও বিবাহপূর্ব বেহায়াপনার দিকে যে উসকে দিচ্ছে তা নয় বরং তাদের বয়সের উন্মাদনাকে পুঁজি করে, কতিপয় গোষ্ঠী তাদের অশ্লীলতার পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধি হাসিল করতে চায়।
আর এ ভয়ঙ্কর পাপের জন্য পৃথিবীতে যেমন আছে ভয়াবহ গজব তেমনি আখিরাতেও আছে ভয়ংকর শাস্তি।
নবীজী (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, তারা প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে যা তাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে প্রসারিত ছিল না।’ [আলবানী, সহীহুল জামি]
ভালোবাসা শব্দটি পবিত্র। ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি, যা মানুষের মনের গহিনে প্রবাহমান থাকে। ভালোবাসার কারণেই শ্রদ্ধাময়ী মা গর্ভে সন্তান ধারণ করেন।
পিতা কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ভালোবাসার কারণেই বনজঙ্গলের হিংস্র প্রাণীগুলোও স্বজাতিদের নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করে।
ভালোবাসা আল্লাহর মহান দান। সৃষ্টি জগতের প্রতি ভালোবাসার টান হওয়াটই স্বাভাবিক। তবে ভালোবাসার জন্য কোনো ক্ষণ, দিবস-রজনীর প্রয়োজন নেই।
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় পরস্পরকে ভালোবাসে, আমার রেজামন্দির আশায় পরস্পর বৈঠকে মিলিত হয়, আমার সন্তুষ্টির কামনায় পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করে এবং আমার ভালোবাসার জন্যই নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের ভালোবাসা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। [মুসলিম]
১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে নামে ইসলামবহির্ভূত নির্লজ্জ দিবস উদযাপন নিষেধ। বিবাহের আগে তরুণ-তরুণীর পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা-মেলামেশা, প্রেম-ভালোবাসা ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণভাবে হারাম।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে বাংলাদেশেও ভালোবাসা দিবসের নামে তরুণ-তরুণীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। আজ সামজে পবিত্র ও সত্যিকার প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধার অভাবে সর্বত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে হিংসা-বিদ্বেষ, গুম, খুন ও ধর্ষণের মতো অসংখ্য অপরাধ।
তাই দিবস কেন্দ্রীক ভালোবাসার কথা ভুলে একসঙ্গে বলি, প্রতিদিন জয় হোক পবিত্র, অকৃত্রিম, নিঃস্বার্থ প্রেম-ভালোবাসার।