কুরআনের প্রথম বাণী-‘পড়ো, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামই প্রথম মূর্খতা, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলাম জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষাকে প্রধান ও প্রথম কর্তব্য হিসাবে ঘোষণা করেছে। তৎকালীন আরবে স্বয়ং বিশ্বনবি (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নবি যুগের শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে লিখেছেন-
শামসীর হারুনুর রশীদ
হিজরতপূর্ব মক্কাকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
ইসলামি জ্ঞানচর্চার জন্য হিজরতের আগে মক্কায় ইসলাম ও মুসলমানের জন্য কেন্দ্রীয় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। যখন যেখানে থাকতে পেরেছেন, সেখানেই আগ্রহভরে শিক্ষাদীক্ষার আঞ্জাম দিয়েছেন। দিবারাত্রি অবস্থার পটপরিবর্তন হতো, সে কারণে মহানবি (সা.) ব্যক্তিগত-উপানুষ্ঠানিক ভিন্নভাবে ইসলামি শিক্ষা দিয়েছেন। হজ মৌসুমে কখনো মসজিদে আবুবকরে, দারে আরকামে, বায়তে ফাতেমা কিংবা শুয়াবে আবি তালিবে। বিভিন্নজনের ঘরে এবং নানা উপায়ে। তখন শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন, রাসূল (সা.), হজরত আবুবকর (রা.), হজরত খাব্বাব ইবনু আরত (রা.) প্রমুখ। (খাইরুল কুরুন কি দরসগাহ, কাজি আতহার মুবারকপুরি : ২৪।)
ইতিহাসের প্রথম মাদ্রাসা ‘দারুল আরকাম’
ইসলামের ইতিহাসে ‘দারুল আরকাম’ হলো প্রথম আনুষ্ঠানিক ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র বা মাদ্রাসা। সাহাবিদের পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দীক্ষিত করার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুয়তের ৫ম বর্ষে ‘দারুল আরকামে’ অবস্থান নেন। এটি ছিল সাফা পাহাড়ের ওপরে নওমুসলিম আরকাম ইবনু আবুল আরকাম ইবনু আব্দে মানাফের বাড়ি। এ ‘দারুল আরকামে’ মহানবি (সা.) প্রথম ইসলামি জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। সেখানে ইসলাম গ্রহণকারী মুসলিমদের কুরআন, নামাজ ও নৈতিকতা শিক্ষা দিতেন। পাশাপাশি এ বাড়ি থেকে মহানবি (সা.) দাওয়াতের কাজ করতেন। (খাইরুল কুরুন কি দরসগাহ : ২৭।)
মাদ্রাসা মসজিদু আবুবকর (রা.)
একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, আবুবকর সিদ্দিক (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর তার গৃহে ‘দারুল আরকামের’ আগে ইসলামের প্রথম উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করেছিলেন। সেখানে নামাজের প্রশিক্ষণ হতো, কুরআনের তেলাওয়াত হতো। পরে সেটি মসজিদে আবুবকর (রা.)-এ রূপ নেয়। সহিহ বুখারির কিতাবুল কাফালায় বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, মসজিদে আবুবকরে কোনো মুয়াল্লিম বা শিক্ষক নিয়োগ করা ছিল না। আবুবকর (রা.) নিজেই সেখানে তালিমের কাজ করতেন। এখানে অমুসলিম ছেলেমেয়েরাও কুরআনের তেলাওয়াত শোনায় অংশ নিত। (খাইরুল কুরুন কি দরসগাহ : ২৫।)
মাদ্রাসা ফাতেমা বিনতে খাত্তাব
ইবনু হিশাম হজরত ওমর (রা.)কে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘খাত্তাবের কন্যা ও ওমর (রা.)-এর বোন ফাতেমা ও তার স্বামী সাঈদ ইবনু জায়েদ (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর তার নিজ গৃহে একটি ইসলামি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে রাসূল (সা.)-এর সাহাবি খাব্বাব ইবনু আরত (রা.) তাদের ও নওমুসলিমদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। ওমর ইবনু খাত্তাব (রা.) ইসলাম গ্রহণপূর্ব এ ঘরে এসে নিজ বোন ও ভগ্নিপতিকে কুরআন শিক্ষায় পেয়ে এবং ইসলাম গ্রহণের দায়ে মারপিট করেন (খাইরুল কুরুন কি দরসগাহ : ২৬)।
হিজরত পূর্বযুগে মদিনায় ইসলামি শিক্ষা
মদিনার নেতৃস্থানীয় কিছু লোক মহানবি (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রথম বছর ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে হজের সফরে মক্কায় আসেন। মহানবির মুখ-নিঃসৃত ইসলামের অমিয়বাণী ও দাওয়াত শুনে তারা আগ্রহভরে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাদের নিয়েই আকাবার প্রথম বাইয়াত অনুষ্ঠিত হয়। পরে মদিনার আউস-খাজরাজ গোত্রের নেত্রীবর্গ ও জনসাধারণ দলে দলে ইসলাম কবুল করতে থাকেন। জাবির (রা.) বর্ণনা মতে-হিজরতের দুবছর আগে মদিনায় মসজিদ নির্মাণ ও কুরআন শিক্ষা শুরু হয় এবং উপানুষ্ঠানিক ৩টি শিক্ষা নিকেতন বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে (ফতহুল বুলদান, আল-বালাযুরি : ৪৫৯)।
মাদ্রাসা মসজিদু বনি জুরায়েক
তাবাকাতে ইবনু সাদ গ্রন্থের বর্ণনা মতে, ‘মসজিদে বনি জুরায়েক’ ছিল মদিনার প্রথম মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন-খাজরাজ গোত্রের দলপতি রাফে ইবনু মালিক জুরাকি (রা.) যিনি আকাবার প্রথম বাইয়াতে ইসলাম গ্রহণ করেন। মহানবি (সা.) হিজরত করে মদিনায় এসে কুরআনের এ শিক্ষাকেন্দ্র এবং তার শিক্ষাদানের রুচি-মেধা-বুদ্ধিমত্তা দেখে খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। আল-এসাবা গ্রন্থে বলা হয়েছে-মদিনার প্রথম মসজিদ যেখানে কুরআন শিক্ষা দেওয়া হতো, সেটি-‘মসজিদে বনু জুরায়েক’ (আল-ইসাবা ফি তামিজিস সাহাবা, আসকালানি, ২য় খণ্ড : ১৯০)।
মাদ্রাসা মসজিদুল কুবা
‘মাদ্রাসা মসজিদুল কুবা’-এটি ছিল মদিনার দ্বিতীয় মাদ্রাসা। মদিনার দক্ষিণ দিকে কুবা নামক স্থানে অবস্থিত। পরে সেখানে কুবা মসজিদ নির্মিত হয়। ‘মসজিদে কুবা’ মদিনায় নির্মিত ইসলামের প্রথম মসজিদ। আকাবার বাইয়াতের পর মক্কার কিছুসংখ্যক সাহাবি নিরাপদ আশ্রয়ের লক্ষ্যে কুবায় সমবেত হতে থাকেন। তাদের মধ্যে আবু হুজায়ফা (রা.)-এর পালকপুত্র সালিম (রা.) বড় আলেম ও কারি ছিলেন। তিনি কুবায় সমবেত সাহাবায়ে কেরামের নামাজের ইমামতি করতেন এবং কুরআন শিক্ষা দিতেন (ওফা আল-ওফা, ২য় খণ্ড : ৮৫; ফুতুহুল বুলদান : ৪৫৯)।
মাদ্রাসা নাকিউল খাজিমাত
এটি ছিল মদিনার তৃতীয় মাদ্রাসা। মদিনা থেকে মাইলখানেক দূরবর্তী উত্তর দিকে নাকিউল খাজিমাত নামক স্থানে আসআদ ইবনু জুরারাহ (রা.)-এর ঘর ‘র্হারায়ে বনি বিয়াজায়’ প্রতিষ্ঠত হয়েছিল। মক্কা শরিফে আকাবার বাইয়াতের সময় মদিনাবাসী মুসলমানদের কুরআন শিক্ষা ও ইসলামি জ্ঞানদানের জন্য রাসূল (সা.) মুসআব ইবনু উমায়ের (রা.)কে শিক্ষক মনোনীত করে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রেরণ করেন। সঙ্গে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনু উম্মে মাকতুম (রা.)। আসআদ ইবনু জুরারা খাজরাজি ছিলেন প্রতিনিধি দলের দলপতি। মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে তিনি তার বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেন কুরআনের এ শিক্ষাকেন্দ্র। (উসদুল গাবা, আল-জাযারি, ৪র্থ খণ্ড : ৪৬৯; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ, ১ম খণ্ড : ৩০।)
মদিনার উপানুষ্ঠানিক মাদ্রাসা
উল্লিখিত ৩টি মাদ্রাসা ছাড়াও এ সময় মদিনার বিভিন্ন গোত্র ও মহল্লায় সাময়িক নানা শিক্ষালয় বিদ্যমান ছিল। যেমন-বনু নাজ্জার, বনু আবদুল আশহল, বনু জুফার, বনু আমর ইবনু আওফ, বনু সালেম ইত্যাদি গোত্রগুলোর মসজিদে ইসলামি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। উবাদা ইবনু সামিত, উতবাহ ইবনু মালিক, মুয়াজ ইবনু জাবাল, ওমর ইবনু সালামাহ, উসায়েদ ইবনু হুজায়ের, মালিক ইবনু হুয়াইরিস (রা.) প্রমুখ ছিলেন এসব মসজিদের ইমাম ও শিক্ষক (আল ইশতেকাক, ইবনু দুরায়েদ : ২৬; সিরাতে ইবনু হিশাম, ১ম খণ্ড : ৪৩৪)।
মাদ্রাসা আসহাবে সুফফা
একদিন রাসূল (সা.) মসজিদে নববিতে সাহাবিদের সমবেত দেখে বলেলন, ‘আমি তোমাদের জন্য শিক্ষক হিসাবেই প্রেরিত হয়েছি’ (সুনানে বায়হাকি : ২৫৮; মুসনাদে আহমদ : ৫-১৫৩)। এরপর থেকে রাসূল (সা.) তাদের নিয়মিত শিক্ষা দিতে লাগলেন। এখান থেকেই শুরু হয় ইসলামি শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ ক্রমধারা। নবিজির পাঠশালায় যে শিক্ষার্থী আসত তাকে স্বাগতম জানিয়ে শিক্ষাগ্রহণের মর্যাদা লাভের সুসংবাদ দেওয়া হতো। মসজিদে নববিতে রাসূল (সা.)-এর শিক্ষালয়ে স্থানীয় ছাত্রদের ভিড় লেগে থাকত।
মক্কা থেকে হিজরত করে আসা একদল নিঃস্ব মুহাজির সাহাবি বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির চত্বরে আশ্রয় লাভ করেন। রাসূল (সা.) তাদের চত্বরের উত্তর-পূর্ব কোনায় অবস্থান করতে বলেন এবং এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দিতে বলেন। তখন থেকে এটা পরিচিতি পায় আল-সুফ্ফা বা আল-জুল্লাহ নামে যার অর্থ ছায়া। এখানে যারা উপস্থিত থাকতেন তাদের বলা হতো ‘আসহাবে সুফফা’ (ফতহুল বুলদান : ৪৫৯)।
রাসূল (সা.) দ্বিতীয় হিজরিতে মসজিদে নববির চত্বরে এটিকে কেন্দ্র করে পূর্ণাঙ্গ একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরিচালক ও প্রধান শিক্ষক ছিলেন খোদ রাসূল (সা.)। ইতিহাসের পাতায় মক্কার ‘দারুল আরকাম’-এর পর মূলত এখান থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা। ঐতিহাসিকরা ‘মাদ্রাসা আসহাবে সুফফা’কে পৃথিবীর প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন (খাইরুল কুরুন কি দরসগাহ : ২৮-৩৮)।