সকাল নারায়ণগঞ্জ
বাবার চোখে ঘুম নেই ছেলে যাবে বিদেশে, ভিসার জন্য গোছাতে হবে টাকা। স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণে প্রথম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপনের আগেই স্বামী চলে যাবে ভিন দেশে সে কষ্ট স্ত্রীর। আর মায়ের কাছ থেকে দূর পরবাসে যাবে সন্তান সে কষ্টে মায়ের আর্তনাদ সীমাহীন। এরই মধ্যে সংবাদ আসে সেই সন্তান চলে গেছে না ফেরার দেশে। যেখান থেকে আর কখনোই ফিরে আসবেনা। আকাশ-বাতাস ভারি হয়েছে বাবা-মা আর স্ত্রীর কান্নায়।
ঘটনার শুরু যেভাবে- নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচন ছিল ১৬ জানুয়ারি। সারা দেশের সবার চোখ তখন নির্বাচন নিয়ে। এরই মধ্যে দুপুরে পুলিশের কাছে সংবাদ আসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জাঙ্গাল এলাকায় রাস্তার পার্শ্বে পড়ে আছে একটি লাশ। দ্রুত ছুটে যান বন্দর থানার এসআই/ ফয়সাল আলম। উপস্থিত লোকজন কেউ লাশটির পরিচয় জানেনা। অজ্ঞাত লাশ হিসেবে শুরু হয় আইনী কার্যক্রম। কে, কিভাবে, কখন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাও অজানা। নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র নেই পুলিশের নিকট। তবে লাশের পকেটে পাওয়া যায় একটি মোবাইল। তারই সূত্র ধরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় উদঘাটন হয় মৃত ব্যক্তির পরিচয়। তার নাম আকাশ(২১), পিং- মোতালেব, সাং- সুজানগর, থানা- কোতয়ালী, জেলা- কুমিল্লা। সংবাদ পেয়ে ছুটে আসেন বাবা ও তার পরিবার। সনাক্ত করে লাশ। অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে রুজু করেন বন্দর থানার মামলা নং- ১০, তাং- ১৭/০১/২২ খ্রি, ধারা- ৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড।
যেভাবে উদঘাটন হল রহস্য:- তদন্তকারী অফিসার এসআই/ ফয়সাল আলম তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা ও অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞান দিয়ে শুরু করেন তদন্ত কার্যক্রম। পুলিশ সুপার জনাব মোহাম্মদ জায়েদুল আলম, পিপিএম (বার) এর নির্দেশনায় নারায়ণগঞ্জ ’খ’ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জনাব শেখ বিল্লাল হোসেন মামলাটির তদারকি এবং কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করতে থাকেন। তদন্তকালে প্রকাশ পায় ভিকটিম আকাশ ছিলেন একজন খন্ডকালীন ট্রাক হেলপার। ঘটনার তিন দিন আগে অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আর ফিরে যায়নি বাড়িতে। তবে কে বা কার সাথে হেলপারি করেছে তা ছিল অজানা।
এরপর শুরু হয় তথ্যপ্রযুক্তির চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং অন্বেষণ। কুমিল্লার বিভিন্ন ট্রাক স্ট্যান্ডে চলে গোপন তৎপরতা। তদন্তকারী অফিসার কখনও চালক, কখনও হেলপার বা ব্যবসায়ী পরিচয়ে ছদ্দবেশে খুঁজতে থাকেন সেই চালককে। অবশেষে কিছুটা আশার আলো পান চালকের নাম পেয়ে। তবে কেউ ঠিকানা বলতে পারেন না। অপরদিকে ঘটনার পর থেকে সে ট্রাক স্ট্যান্ডে নেই। সন্দেহের তীর যখন সেই চালকের দিকে তখন অনেক চেষ্টা আর তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় পাওয়া যায় তার ঠিকানা। খোঁজ নেয়া হয় তার বাড়িতে। কিন্তু সেখানে নেই সে।
এরপর তদন্তে আনা হয় নতুন কৌশল। একজন চাউল ব্যবসায়ী সেজে কাঙ্খিত সেই ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ট্রাক ভাড়া নেয়ার কথা বলে ঠিক করা হয় তাকে। তারপর সময় অনুযায়ী ২৯ জানুয়ারি চলে আসে ট্রাকসহ চালক। পূর্ব পরিকল্পনা মতে আটক করা হয় আসামি ট্রাক চালক আরিফুর রহমান ওরফে টিটু (৩০), পিতা- মৃত ফিরোজ মিয়া, মাতা- রোকেয়া বেগম, সাং- বুড়িচং উত্তরপাড়া, থানা- বুড়িচং, জেলা- কুমিল্লাকে। জিজ্ঞাসাবাদে দেয় অসংলগ্ন তথ্য। তবে কিছু গোপন করছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তদন্তকারী দলের নিকট। বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ পূর্বক নেয়া হয় তিন দিনের পুলিশ রিমাণ্ডে। চলে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ। তথ্য প্রযুক্তি এবং তার দেয়া তথ্যের চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে স্বীকার করেন তিনিই খুন করেছেন ভিকটিম আকাশকে। আসামীর দেয়া তথ্য ও সনাক্তমতে হত্যাকাণ্ডের সময় ব্যবহৃত ট্রাক উদ্ধারপূর্বক জব্দ করা হয়। ০১ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞ আদালতে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়ে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে গ্রেফতারকৃত আসামি আরিফ ওরফে টিটু। যেভাবে হত্যা করা হয়:- ১৩ জানুয়ারি, ২০২২ খ্রি. রাতে ট্রাক চালক আরিফ ও হেলপার আকাশ কুমিল্লা ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে গাঁজা সেবন করে। এরপর ট্রাকে পুরাতন বই ও কাগজ নিয়ে ঢাকার মাতুয়াইলের উদ্দেশ্য কুমিল্লা থেকে রওনা করে। সারারাত গাড়ী চালিয়ে ক্লান্ত দুজন সিমরাইল ট্রাক স্ট্যান্ডে এসে ট্রাকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। ১৪ তারিখ সকালে ট্রাকে থাকা মালের পার্টি ফোন দিয়ে মাল দ্রুত পৌঁছে দিতে বলে। চালক আরিফ ওরফে টিপু হেলপার আকাশকে ঘুম থেকে উঠতে ডাকে।
ক্লান্ত ও অবসন্ন আকাশ ঘুম থেকে উঠতে অপারগতা জানায়। এসময় চালক তাঁকে মা-বাবা তুলে গালি দেয়। প্রতিউত্তরে হেলপারও তাকে গালি দেয়। এসময় চালক আরিফ ওরফে টিপু ট্রাকের সিটের সাথে গলা চেঁপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে হেলপার আকাশকে। ঠান্ডা মাথার খুনি আরিফ ওরফে টিপু এসময় হেলপার আকাশের লাশ ট্রাকের সিটের পিছনে লুকিয়ে রেখে গাড়ি চালিয়ে মাতুয়াইল গিয়ে মাল নামিয়ে দেয়। সেদিন ছিল শুক্রবার। জুম্মার নামাজের ঠিক আগ মূহুর্তে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। এ সময়টাকে বেছে নেয় ভয়ঙ্কর এ খুনি। লাশসহ গাড়ি চালিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জাঙ্গাল এলাকায় গিয়ে রাস্তার পার্শ্বে ফেলে যায় আকাশের লাশ।
এমন রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড এবং ভয়ঙ্কর ঠান্ডা মাথার খুনিকে বিজ্ঞ আদালত জেল হাজতে প্রেরণ করেছেন। তদন্তকারী অফিসার দ্রুত মামলাটি তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দাখিল করবেন। আইন তার নিজস্ব গতিতে চালাবে বিচারিক প্রক্রিয়া। সাক্ষ্য প্রমাণে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের চেষ্টা করবে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু মায়ের কোলে ফিরবেনা আকাশ আর কখনও, স্ত্রীর সাথে প্রথম বিবাহ বার্ষিকী হবেনা উদযাপন, বাবা ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে আর ঘাম ঝরাবেনা। সামান্য চা দোকানদার বাবা মোতালেব যে স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলে বিদেশে গিয়ে সংসারের হাল ধরবেন সে স্বপ্নও আর দেখবেনা। সাধারণ মানুষ শুধু এমন রোমহর্ষক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখার অপেক্ষায় থাকবে, যাতে এমন ঘটনার আর কোন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আকাশের মত আর কোন পরিবারের এক আকাশ স্বপ্ন কোনদিন যাতে ভেঙ্গে না যায়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের এমন ক্লু-লেস হত্যা রহস্য উদঘাটনে সাধুবাদ জানিয়েছেন ভিকটিমের পরিবার ও সাধারণ জনগন।