সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ
পবিত্র শবে কদর প্রাপ্তির সুনিশ্চিত প্রত্যাশায় সর্বোপরি মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত।
রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ রাসুলুল্লাহর (সা.) গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত আমল। ফরজ ইবাদত ব্যতিত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যেসব ইবাদত করা হয় তার মধ্যে এতেকাফ একটি অন্যতম ইবাদত।
রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার জামে মসজিদে কোনো রোজাদার মুসলিম এতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে এ ধরনের সুন্নত আদায় হবে।
তাই এলাকাবাসীর কেউ যদি এতেকাফ না করে তা হলে সুন্নত ছেড়ে দেয়ার কারণে সবার সুন্নত তরকের গুনাহ হবে।এতেকাফ আরবি ‘আকফ’ মূল ধাতু থেকে গঠিত একটি শব্দ।
আকফ শব্দের অর্থ হলো অবস্থান করা। এতেকাফ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায় নির্ধারিত সময়ে সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে পার্থিব ও জাগতিক সব ধরনের সংস্পর্শ ত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।
পবিত্র কোরআনে সুরা বাকার ১২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন-‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে (কাবা) তাওয়াফকারীদের জন্য, এতেকাফকারীদের জন্য ও (সর্বোপরি তার নামে) রুকু-সিজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখে।
পবিত্র কোরআন কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা সালাতের নির্দিষ্ট স্থানগুলোয় অবস্থানরত’। (সুরা বাকারা : ১৮৭)। মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘আর মসজিদে যখন তোমরা ইতেকাফ অবস্থায় থাকবে তখন স্ত্রী-সম্ভোগ থেকে বিরত থাকো। সিয়ামের ব্যাপারে এগুলোই হলো আল্লাহর সীমারেখা’। (সুরা বাকারা : ১৮৭)।
২০ রমজান সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে ২৯ অথবা ৩০ রমজান অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার পূর্ব পর্যন্ত পুরুষদের জন্য মসজিদে এবং নারীদের জন্য নিজ গৃহে নামাজের নির্ধারিত স্থানে নিয়মিত একাধারে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।
শরিয়তের পরিভাষায় যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতসহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়তসহকারে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।
এতেকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ।
মহানবী (সা.) স্বয়ং এতেকাফ করেছেন এবং এতেকাফ করার জন্য সাহাবিদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
২০ রমজান সূর্যাস্তের প্রাক্কাল থেকে মসজিদে এতেকাফ শুরু করবেন এবং ২৯ বা ৩০ রমজান শাওয়াল মাসের চাঁদ দখার পরে এতেকাফকারীরা মসজিদ থেকে বের হবেন।
রমজান মাসের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করলে ২৭ রমজান যদি শবেকদর নাও হয়, তবু এ ১০ দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট শবে কদরের ইবাদত এতেকাফে আদায় হয়ে যায় এবং এর ফলে শবে কদরের রাতের ফজিলতও লাভ করা যাবে।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত হজরত মুহাম্মদ (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করতেন। (বোখারি: ২০২৫) হজরত আয়েশা (রা.) আরো বলেন, ‘নবী করিম (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ পালন করতেন। তার ওফাতের আগ পর্যন্ত তিনি এতেকাফ পালন করে গেছেন। তারপর তার পত্নিরাও তা পালন করেছেন।’ (তিরমিজি : ৮০৮)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষের দশকে ইতেকাফ করেছেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তার স্ত্রীগণ ইতেকাফ করেছেন। (বোখারি : ২০২৬)।
হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করবে, সে দুটি ওমরাহ ও দুটি হজ আদায় করার সওয়াব পাবে’। (বোখারি : ২৭২৪)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এতেকাফ করবে, আল্লাহতায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। (শোয়াবুল ঈমান : ৩৯৬৫)।
এতেকাফের শর্ত
এতেকাফের শর্তগুলো হলো। ১. নিয়ত করা। ২. জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে এতেকাফ করা। ৩. এতেকাফকারী রোজাদার হওয়া।
৪. জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান স্ত্রী-পুরুষের জানাবাত ও মহিলারা হায়েজ-নেফাস হতে পাক হওয়া। ৬. পুরুষ লোক জামে মসজিদে এতেকাফ করা। ৭. সর্বদা হদসে আকবর থেকে পাক-পবিত্র থাকা।
এতেকাফের প্রকার
এতেকাফ ৩ প্রকার। সুন্নত এতেকাফ: রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে এতেকাফ করা। এ ধরণের এতেকাফকে সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই এতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।
ওয়াজিব এতেকাফ: নজর বা মানতের এতেকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এত দিন এতেকাফ করব অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই এতেকাফ করব। যত দিন শর্ত করা হবে তত দিন এতেকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নত এতেকাফ ভঙ্গ করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
নফল এতেকাফ: সাধারণভাবে যেকোনো সময় এতেকাফ করা নফল। এর কোনো দিন কিংবা সময়ের পরিমাপ নেই। অল্প সময়ের জন্যও এতেকাফ করা যেতে পারে। এজন্য মসজিদে প্রবেশের আগে এতেকাফের নিয়ত করে প্রবেশ করা ভালো।
ওয়াজিব এতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। জাহের রেওয়ায়েত মতে, নফল এতেকাফকারীর জন্য রোজা শর্ত নয়। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, নফল এতেকাফকারীর জন্যও রোজা রাখা শর্ত।
যদি কেউ রোজা ব্যতিত এক মাস এতেকাফ মান্নত করে, তার প্রতি রোজা ব্যতিত এক মাস এতেকাফ ওয়াজিব হবে। যদি কেউ রমজান মাসে এতেকাফের মান্নত করে, তা হলে ভিন্নভাবে রোজা রাখার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু রমজান মাসে মান্নত আদায় না করলে পরবর্তী সময়ে রোজার সঙ্গে ওই এতেকাফ আদায় করতে হবে। স্ত্রী অথবা ক্রীতদাস-দাসী এতেকাফের মান্নত করলে স্বামী অথবা মনিব তা নিষেধ করার ক্ষমতা রাখেন।
রমজানের শেষ ১০ দিনের এই এতেকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। অর্থাৎ কোনো বস্তি বা মহল্লার একজনকে হলেও এই এতেকাফ অবশ্যই করতে হবে।
যদি অন্তত কোনো এক ব্যক্তি এই এতেকাফ করে নেন, তা হলে মহল্লবাসীর পক্ষ থেকে এতেকাফ আদায় হবে; কিন্তু মহল্লাবাসীর মধ্যে থেকে কেউ যদি এতেকাফ আদায় না করেন, তবে এই দায়িত্বের প্রতি অবহেলার কারণে মহল্লাবাসী গোনাহগার হবেন।
স্মরণ রাখতে হবে, উজরত অর্থাৎ বিনিময় বা পারিশ্রমিক দিয়ে কাউকে এতেকাফে বসানো জায়েজ নয়। কেননা ইবাদতের উজরত দেয়া ও নেয়া উভয়ই শরিয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ। (ফাতওয়ায়ে শামি)।
নারীরা ঘরের যে স্থান এতেকাফের জন্য নির্দিষ্ট করবেন, সে স্থানটি এতেকাফকালীন তার জন্য মসজিদের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইসলামী শরিয়তের কোনো প্রয়োজন ছাড়া সেখান থেকে সরে যাওয়া জায়েজ হবে না। সে স্থানটির নির্দিষ্ট সীমার বাইরে, ঘরের অন্য অংশেও যেতে পারবেন না। নির্দিষ্ট সীমার বাইরে চলে গেলে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
এতেকাফে নবী করিম (সা.) এর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি প্রতি বছর রমজান মাসে এতেকাফের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি কখনো পুরো রমজান মাস এতেকাফ করেছেন। ১০ দিনের এতেকাফ তো তিনি প্রতি বছর অবশ্যই করতেন।
একবার বিশেষ কারণে রমজান শরিফে এতেকাফ করতে পারেননি, তাই শাওয়াল মাসে ১০ দিন রোজা রেখে তিনি এতেকাফ করেছেন ( বোখারি : ২০২৯)।
এতেকাফকালীন অবস্থায় কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ ও অনর্থক গল্প-গুজব বা বেহুদা কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। দুনিয়াবি কোনো লেনদেন না করার পাশাপাশি বিনা প্রয়োজনে মসজিদথেকে বের হওয়াও অনুচিত।
এতেকাফ অবস্থায় বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করার পাশাপাশি নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ, দান-সদকা ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত।
লেখক: প্রধান শিক্ষক, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, ও সভাপতি, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক ঐক্য পরিষদ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।