সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ
চীনের উহান প্রদেশে নভেল করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশটি ইউরোপে এই মহামারীর কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছে।
যেখানে চীনে ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ৮১,৪৩২ জন (২২ মার্চ ২০২০) করোনায় নিশ্চিত সংক্রমিত হয়েছেন সেখানে মাত্র ছয় কোটি মানুষের দেশ ইতালিতে ২২ মার্চ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৫৯,১,৩৮ জন।
প্রথম ৫২ দিনে মারা গেলো ৫ হাজার ৪৭৬ জন যার ৮০ শতাংশই মারা যায় শেষ ১০দিনে! ভাবা যায়?
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিলে যারা যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে বিশ্বে এখন সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে ইতালি।
এ বছরের ৩১ জানুয়ারি ইতালিতে প্রথম কোভিড-১৯ রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় রোমে; তারা হলেন দুইজন চাইনিজ পর্যটক। এর এক সপ্তাহের মাথায় একজন ইতালিয়ান আক্রান্ত হন যিনি চীনের উহান শহর থেকে ফিরেছেন।
ইতালীয় বিশেষজ্ঞরা এই ভেবে সন্তুষ্ট থাকেন যে কোভিড-১৯ মূলত বিদেশফেরতেদের মধ্যেই সীমিত। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তাদের এ ভুল ভাঙলো যখন তারা দেখলেন যে উত্তরাঞ্চলের লোম্বার্ডি প্রদেশে ৩৮ বছর বয়সের একজন ইতালিয়ও আক্রান্ত হয়েছেন। এই ভদ্রলোক নিকট অতীতে দেশের বাইরে যাননি এবং বিদেশ ফেরত কারো সংস্পর্শে আসেননি। পরেরদিনই লোম্বার্ডিতে ১৬ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যাক্তিকে শনাক্ত করা হয়।
বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ,সমাজবিজ্ঞানী ও জনসংখাবিদগণ ইতালির এ অবস্থার পেছনের কারণ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। তারা মনে করছেন,ইতালির অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর জন্য নতুন শিক্ষা নিয়ে এসেছে। এ শিক্ষা বাংলাদেশর জন্যেও প্রযোজ্য হতে পারে। যে বিষয়গুলো ইতালির এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী:
ক) ধীরে চলা নীতি ও মিশ্র কথাবার্তা: অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন ইতালি সরকার একটু একটু করে প্রথমে শহর, পরে প্রদেশ, পরে সারা দেশ লকডাউন করে যা করোনাভাইরাসকে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। এই ধীরে চলো নীতির কারণে ইতালির নাগরিকেরা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি।
অনেক শিল্প-কারখানার শ্রমিকরা কাজ করেছেন। মহামারীর প্রথম দিকে রাজনৈতিক নেতাদের ঢিলেঢালা মন্তব্য অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টিকে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে উপস্থাপন করেছে।
ইটালির লোম্বার্ডি প্রদেশ, যেখানে কোভিড-১৯ সবচেয়ে বড় আঘাতটি করেছে,সেখানকার গভর্নর আত্তিলো ফন্টানা ২৫ ফেব্রুয়ারী সংসদে মন্তব্য করেন “এটা (কোভিড-১৯) সাধারণ জ্বর থেকে সামান্য একটু বেশি”। তার এ মন্তব্যের পরদিনই শহরের রোস্তোরাঁ ও পানশালাগুলোতে ভিড় বেড়ে যায়।
এমনকি যখন একে একে বিভিন্ন প্রদেশ লকডাউন হতে থাকে, তার বিপরীতে মিলান এর গভর্নর ‘মিলান বন্ধ হবে না’ স্লোগান নিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেন। এরকম বেশ বিপরীতমুখী বার্তা নাগরিকদের মনে সংশয় তৈরি করে। যখন ইতালিতে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ২,৭০৩ তখন তারা স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে।
যদিও ইতালির সরকার ৯ মার্চ দেশের সব অঞ্চল লকডাউন করে, কিন্তু তারপরেও বেশ কয়েকদিন লোকজন রাস্তায় ছিলেন। ভিড় করে তারা আড্ডাবাজি করেছেন। এমনকি স্কি অবকাশ যাপন কেন্দ্রগুলো উপচে পড়েছে তরুণদের পদচারণায়।
খ) ইতালির জনমিতি:
ইতালি বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্কদের দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। এদের বয়সের মধ্যমা (median) ৪৫.৪ বছর যা চীনের চেয়ে সাত বছর বেশি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে সামান্য বেশি। গত শুক্রবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এপর্যন্ত ইতালিতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন যারা তাদের গড় বয়স ৬৩ বছর। আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের গড় বয়স ৭৮.৫ বছর। এদের প্রায় সবাই (৯৯ শতাংশ) কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেই কমপক্ষে একটি অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ বয়স্ক এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের বেশিমাত্রায় দূর্বল করে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
গ) স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনা সংকট:
ইতালির উত্তরে লোম্বার্ডি অবস্থিত যেখানে কোভিড-১৯ প্রথম আক্রমণ শুরু করে। আক্রান্তদের সংখ্যা এবং গতিধারা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় প্রথমদিকে সংক্রমণের হার যথেষ্ট কম থাকলেও দু’সপ্তাহের মধ্যে হু হু করে বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্য বিভাগ সাধ্যমত চেষ্টা করেও আক্রান্তদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারেনি। রূঢ় বাস্তবতা হলো তারা এমন পরিস্থিতির জন্য তৈরিই ছিল না। হাসপাতালের বিছানা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাঁচার সম্ভাবনা যাদের বেশি তাদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে চিকিৎসা দেয়।
দুঃখজনকভাবে যারা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয় তাদের অধিকাংশই পরে মারা যায়। হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভিড়কে কোনভাবেই ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ফলে অনেক আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে ফেরত গিয়েছেন। পৌনঃপুনিকভাবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়াতে থাকে এবং স্বল্প সময়ে পুরো দেশটা গ্রাস করে ফেলে।
ঘ) কোভিড-১৯ পরীক্ষার কিট সংকট:
ধারণা করা হয়,করোনাভাইরাস সংক্রমিত প্রথম ব্যক্তিটি শনাক্ত করার অনেক আগেই কোভিড-১৯ ইতালিতে অনুপ্রবেশ করে। তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষকরা দেখেন প্রথম ব্যক্তি শনাক্ত হবার বেশ আগে ইতালির উত্তরাঞ্চলের কনডঙ্গো হাসপাতালে নিউমিনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখা রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে যায়।
ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান স্টেফিনো পাগলিয়া মনে করেন, কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তিরাই ওই সময়টাতে ভিড় করেন, কিন্তু সময়মত করোনাভাইরাস পরীক্ষা না করার কারণে তাদের শনাক্ত করা যায়নি।
বিশ্বের বহু দেশের মতো ইতালিতেও করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিটের সংকট দেখা দেয়। ফলে সংক্রমিত আনেক ব্যক্তিকেই শনাক্ত করা ও আলাদা রাখা সম্ভব হয়নি।
ইতালিতে শুধুমাত্র কোভিড-১৯ এর লক্ষণ ও উপসর্গ যেমন জ্বর কিংবা শুকনো কাশি আছে এমন ব্যক্তিদেরকেই করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হতো। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও সিংগাপুর করোনাভাইরাস পরীক্ষা ব্যাপকহারে শুরু করে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণ কমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
তবে, ইতালি নিয়ে এতো গবেষণা-আলোচনার পরেও অনেকে মনে করেন উপরোক্ত কোন কারণই এই মহামারীর জন্য দায়ী নয়। চূড়ান্তভাবে কোন কিছুকে দায়ী করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত এখনো আমাদের হাতে নেই।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসচা মৌক মনে করেন ইতালিতে করোনাভাইরাস মহামারীর আসলে কোন কারণই নেই!
লেখক: ওমর ফারুক
উন্নয়নকর্মী ও গবেষক
ইমেইল: [email protected]