সব প্রশংসা আল্লাহতায়ালার, যিনি পবিত্র কোরআন শরিফ নাজিল করেছেন এবং বলেছেন, ‘আমি উপদেশ গ্রন্থ নাজিল করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক’ [সূরাহিজর-৯]
কোরআনের প্রতিটি আয়াত নাজিলের সঙ্গে সঙ্গেই নবীজি (সা.)-এর সাহাবিরা তা মুখস্থ করে ফেলতেন। অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে লিখেও রাখতেন। পরবর্তী সময়ে নবীজি (সা.)-এর মৃত্যুর পর খুলাফায়ে রাশেদিনদের সময়ে কোরআন শরিফ একত্রিত করা হয়।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে লেখা কোরআন শরিফের কোনো পাণ্ডুলিপি কি এখনও টিকে আছে? থাকলে সেগুলো কোথায় আছে দেখতে কেমন?
হজরত উসমান (রা.)-এর সময় লিপিবদ্ধ কোরআন শরিফের পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া না গেলেও বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে, গ্রন্থাগারে কোরআন শরিফের এমন কয়েকটি পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে, যেগুলো রচিত হয়েছিল নবীজি (সা.)-এর মৃত্যুর পর প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শতকেই।
চলুন জেনে নিই বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কোরআন শরিফের প্রাচীনতম কয়েকটি পাণ্ডুলিপির ইতিবৃত্তান্ত-
১. বার্মিংহাম পাণ্ডুলিপি : ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত কোরআন শরিফের দুটি পাতাকে কোরআনের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি বলা হয়। রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ৯৫.৪ শতাংশ নিশ্চয়তা দিয়ে দাবি করেছেন, ‘এই পাণ্ডুলিপিটি লেখা হয়েছিল ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। কোরআন শরিফ নাজিল হয়েছিল ৬০৯ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ জন্য ধারণা করা হয়, এটি নবীজি (সা.)-এর জীবিত অবস্থায় কিংবা তার মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।
পাণ্ডুলিপিটির মাত্র দুটি পাতার সন্ধান পাওয়া গেছে। একটি পাতায় আছে সূরা আল-কাহফের ১৭-৩১ আয়াত, অন্য পাতায় আছে সূরা মারিয়ামের ৯১-৯৮ আয়াত এবং সূরা তাহার ১-৪০ আয়াত। বলা হয়, পাণ্ডুলিপিটি লেখা হয়েছিল গরুর বাছুর, ছাগল কিংবা ভেড়ার চামড়া থেকে প্রস্তুতকৃত কাগজের ওপর। পাণ্ডুলিপিটিতে হিজাজি লিপি অনুসরণ করা হয়েছে। এর পৃষ্ঠাগুলো দৈর্ঘ্যে ৩৪.৩ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ২৫.৮ সেন্টিমিটার।
২. সানায় পাণ্ডুলিপি : ১৯৭২ সালে ইয়েমেনের গ্রেট মস্ক অফ সানার একটি দেয়াল ধসে পড়লে সেটি সংস্কার করার সময় মাটির নিচে গোপন একটি কুঠুরিতে প্রচুর প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে ৮১টি পাতাকে কোরআন শরিফের পাণ্ডুলিপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোরআন শরিফের অন্য সব প্রাচীন পাণ্ডুলিপির তুলনায় সানার পাণ্ডুলিপিটি একেবারেই ভিন্ন। চামড়া থেকে তৈরি পার্চমেন্টের ওপর এখানে একই সঙ্গে দুটি লেয়ারে ভিন্ন দুটি পাণ্ডুলিপির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ একই কাগজের ওপর প্রথমে একবার কোরআন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো কারণে সেই কালি মুছে ফেলা হয় এবং তার ওপর আবারও নতুন করে কোরআন শরিফ লিপিবদ্ধ করা হয়। পুরনো লিপির কালিতে লৌহচূর্ণের উপস্থিতি থাকায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ছায়ার মতো করে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
রেডিওকার্বন ডেটিং থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে গবেষকরা দাবি করেছেন, ৬৮ শতাংশ সম্ভাবনা আছে পাণ্ডুলিপিটি রচনা করা হয়েছিল ৬১৪ থেকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ৯৫ শতাংশ সম্ভাবনা আছে এটি রচিত হয়েছিল ৫৭৮ থেকে ৬৬৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। অর্থাৎ পাণ্ডুলিপির প্রাচীন লিপিটি নবীজি (সা.)-এর জীবদ্দশায় কিংবা তার মৃত্যুর প্রথম কয়েক দশকের মধ্যেই লেখা হয়েছে।
৩. তুবিনজেন পাণ্ডুলিপি : তুবিনজেন ফ্র্যাগমেন্ট নামে পরিচিত কোরআন শরিফের এ পাণ্ডুলিপিটি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে জার্মানির তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় দামেস্কে নিযুক্ত প্রুশিয়ার কনসাল জোহান গটফ্রাইড ওয়েট্জস্টাইন এটি সংগ্রহ করেছিলেন; যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য আরবি পাণ্ডুলিপির সঙ্গে জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছে।
২০১৪ সালের নভেম্বরে তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, তারা পাণ্ডুলিপির তিনটি পাতা নিয়ে গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন, এটি হিজরি প্রথম শতকে, নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের ২০ থেকে ৪০ বছর সময়ের মধ্যেই লেখা হয়েছিল। কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় ৯৫.৪ শতাংশ নিশ্চয়তা দিয়ে দাবি করেছে, এটি লেখা হয়েছিল ৬৪৯ থেকে ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। অর্থাৎ হজরত উসমান (রা.) কিংবা হজরত আলী (রা.)-এর খেলাফতকালে।
তুবিনজেন ফ্র্যাগমেন্টে ১৭ নম্বর সূরার (আল-ইসরা) ৩৬ নম্বর আয়াত থেকে ৩৬ নম্বর সূরার (ইয়াসিন) ৫৭ নম্বর আয়াত পর্যন্ত লিপিবদ্ধ আছে; যা সম্পূর্ণ কোরআনের প্রায় ২৬.২ শতাংশ। পশুর চামড়া থেকে প্রস্তুতকৃত পৃষ্ঠাগুলোর প্রতিটির আকার দৈর্ঘ্যে ১৯.৫ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ১৫.৩ সেন্টিমিটার, এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় গড়ে ১৮ থেকে ২১টি করে লাইন আছে। আগ্রহীরা এর প্রতিটি পৃষ্ঠা অনলাইনে এখান থেকে দেখতে পারবেন।