সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ
বিশ্বব্যাপী মহামারীর আকার ধারণ করছে করোনা ভাইরাস। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। আরও হাজার হাজার মানুষ ভাইরাসাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
চীন থেকে এর সূচনা হলেও ইউরোপ-আমেরিকা থেকে নিয়ে এশিয়ার সব দেশেই প্রায় কম-বেশি ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। দিল্লি ও ইতালির স্কুল বন্ধ ঘোষণা এসেছে অতি সম্প্রতি। বহু দেশে জুমার নামাজ বন্ধ হয়ে গেছে। আরবে ওমরা যাত্রীদের সফর নিষিদ্ধ হয়েছে। কাবা ঘরের তাওয়াফও সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছড়িয়ে পড়লে শত চেষ্টা করেও হয়ত তা রোধ করা যায় না। যত মানুষের মারা যাওয়ার তা মারা যাবেই। তবুও মানুষের বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কে বা মরতে চায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে? কিন্তু কথা হচ্ছে অযথা ভয়ে ভীত হতে হবে কেন? মৃত্যু মানুষের একবারই আসে। এক মৃত্যুর ভয়ে বারবার মরে যাওয়া মোটেও ভালো কথা নয়।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিদিন আমাদের দেশে কবে আসে এ নিয়ে শঙ্কা বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যে সে ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে কী করব আমরা? অনেকেই ভাবছেন কী আর করব? ঘরের ভেতর গর্ত খুঁড়ে গর্তে লুকিয়ে থাকব। মৃত্যুর প্রহর গুনে বাকি জীবন কাটবে। বাইরে বের হলেই ভাইরাসাক্রান্ত মানুষ থেকে যে কোনোভাবে রোগ আমাকেও গ্রাস করতে পারে। কারো সঙ্গে মেশা যাবে না। কারো গায়ের সঙ্গে গা লাগানো যাবে না। বাজার থেকে খাবার-দাবার কেনাও যাবে না। এককথায় সম্পূর্ণভাবে গর্তজীবী হতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের দুর্যোগ দেন মানুষকে পরীক্ষা করতে। মানুষ অন্য পশুর মতো নয়। নিজের জীবন নিয়েই যার ভাবনা। মানুষকে ভাবতে হবে বিশ্ব মানবতা নিয়ে। অন্তত নিজের সমাজ নিয়ে তাকে ভাবতেই হবে।
মানুষ আল্লাহর খলিফা তথা প্রতিনিধি হিসেবে তাকে অন্যের দুঃখ-কষ্টের সময় নিজেকে উজাড় করে এগিয়ে যেতে হবে সেবায়। সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ না করতে পারলে মানুষ মানুষ নামের উপযুক্ততা থাকে না। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো মানুষ গর্তে একা একা বাস করতে পারে না।
তাই গর্তে লুকানোর চিন্তা না করে আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে মানবিকতার পরীক্ষায়। মরতে তো একদিন হবেই। দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের সেবা করে যদি মরা যায় তাহলে সেই মৃত্যু হবে সার্থক।
হযরত উমর রা-এর শাসনামলে সিরিয়ায় এমন একটি মহামারি দেখা দিয়েছিল। ১৮ হিজরি সনের শুরুতে। হযরত উমর সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা করেছিলেন। তাবুক অতিক্রম করে জানতে পারেন মহামারীর খবর।
সিরিয়ায় তখন আবু উবায়দা রা-এর নেতৃত্বে রোম সাম্রাজ্যের পতন ঘটানো হয়েছে। এর কিছুদিন পূর্বে পারস্য সাম্রাজ্যও বিলুপ্ত হয়েছে। এ অবস্থায় হযরত উমর মুহাজির সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শে বসেন। মুহাজিররা দু’দলে ভাগ হয়ে যান। একদল আল্লাহর ওপর ভরসা করে মহামারী আক্রান্ত এলাকায় যাত্রা বহাল রাখার পরামর্শ দেন। অপর দল নিজ থেকে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে নিরুৎসাহিত করেন।
বিতর্ক হয় দু’দলের মাঝে। হযরত উমর দু’দলকেই উঠে যেতে বলেন। পরদিন আনসারী সাহাবিদের পরামর্শে ডাকেন। আনসারিরাও দু’দলে ভাগ হয়ে যান। তাদের মাঝেও সৃষ্টি হয় তুমুল তর্ক। হযরত উমর তাদেরও উঠে যেতে বলেন।
এরপর হযরত উমর কুরাইশের প্রবীণ অভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। প্রবীণ কুরাইশরা সর্বসম্মতিক্রমে হযরত উমরকে সিরিয়া প্রবেশে বাধা দেন। তাদের যুক্তি ছিল এমন যে, সেখানে বহু মানুষ মহামারীতে আক্রান্ত। আমরা গিয়ে যদি আমরাও আক্রান্ত হই তাহলে তাদের বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। বাইরে থেকে তাদের বিভিন্ন সাহায্য পাঠানোর পথও বন্ধ হয়ে যাবে। হযরত উমর তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আবু উবাইদা রা. উমরকে আপত্তি করে বলেন, হে আমীরুল মুমিনিন, আপনি কি আল্লাহর তকদির থেকে পলায়ন করছেন? উমর খুব রাগান্বিত হন। তিনি বলেন, হে আবু উবাইদা, তুমি ছাড়া অন্য কেউ যদি এ কথা বলত? অর্থাৎ তোমার কাছে আমি এ ধরনের কথা আশা করিনি।
উমর বলেন, হ্যাঁ, আমরা এক তকদির থেকে আরেক তকদিরের দিকে যাচ্ছি। আমরা এখন যা করছি এটাও আল্লাহর তকদির। তার তকদিরের বাইরে নয়।
একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝান, তুমি যদি তোমার বকরি নিয়ে চারণ ভূমিতে যাও, সেখানে দুটি ভূমির একটিতে শুকনো ঘাস আরেকটিতে তাজা ঘাস দেখতে পাও,এমাতাবস্থায় তুমি শুকনো ঘাসের দিকে বকরি না নিয়ে সবুজ তাজা ঘাসের মাঠে বকরি নিয়ে গেলে কি এ কথা বলা যাবে যে, তুমি তকদির থেকে পলায়ন করছ?
শুকনো ঘাসও আল্লাহর তকদির, সবুজ ঘাসও আল্লাহর তকদির। একটি গ্রহণ না করে অপরটি গ্রহণের স্বাধীনতা তোমার রয়েছে।
আব্দুর রহমান ইবন আওফ পরামর্শের সময় অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি ফিরে সব শুনে বললেন, এ বিষয়ে আমার কাছে নবীজীর একটি বিশেষ বার্তা আছে।
রাসূল সা. বলেছেন, কোথাও মহামারী দেখা দিলে তোমরা কেউ বাইরে থেকে সেখানে প্রবেশ করো না। আর যারা পূর্ব থেকেই সেখানে আছে তারা যেন সেখান থেকে বের না হয়। হযরত উমর এ হাদীস শুনে খুব খুশি হলেন। [বুখারী শরীফ]
মহামারী থেকে পালিয়ে কি বাঁচা যাবে মৃত্যু থেকে? মৃত্যু যেখানে আছে সেখানে পৌঁছে যাবেই। এ জন্যই মহামারী থেকে বাঁচতে নিজের অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তার একটি কারণ এও যে, আক্রান্ত মানুষের সেবা করতে লোকের প্রয়োজন হয়। বাইরে থেকে কেউ ঝুঁকি নিতে আসবে না।
এ জন্য উপদ্রুত এলাকায় যারা সুস্থ থাকে তাদের উচিত নিজেদের উজাড় করে অসুস্থদের সেবা করে যাওয়া।
সিরিয়ার ঘটনায় হযরত আবু উবায়দাকে হযরত উমর চিঠি লিখেছিলেন, তোমাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। আমার চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার কাছে চলে আসবে।
আবু উবায়দা বুঝতে পারলেন, হযরত উমর তাকে মহামারী থেকে রক্ষা করতে চাচ্ছেন, তিনি উত্তরে লিখলেন, হে আমীরুল মুমিনিন, আমি দুঃখিত, আপনার কথা রাখতে পারছি না। আমাকে আমার সৈনিকদের সঙ্গে থাকতে দিন। [তারিখে তাবারী]
মূলত আবু উবাইদা রা.তার অধীনস্থ সৈনিকদের মহামারীতে ফেলে একা বাঁচার চিন্তা করতে পারেননি। পঁচিশ হাজার মুসলমানের সঙ্গে হযরত আবু উবাইদাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপর হযরত মুআয সিরিয়াবাসীর নেতৃত্বে ছিলেন। তিনিও মারা যান একই মহামারীতে। এ মহামারীর নাম ছিল আমওয়াস।
প্যালেস্টাইনের ছোট্ট গ্রামের নামে নামকরণ করা হয়েছিল মহামারীর। মহামারীটি সত্যি মহা ছিল। অসংখ্য সাহাবীর প্রাণ গিয়েছিল এতে। কিন্তু তারা শেষ সময় পর্যন্ত বিচলিত হননি। খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন। মুআয রা.-এর পর নেতৃত্বে ছিলেন আমর ইবনুল আস।
হযরত উমর তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কোনো পরিচ্ছন্ন পর্বতের চূড়ায় স্থানান্তরিত হতে। আমর ইবনুল আশপাশের পার্বত্যাঞ্চলে আশ্রয় নেন। এরপর ধীরে ধীরে মহামারীটি শেষ হয়।
এ ধরনের দুর্যোগ এক মহাসুযোগ নিয়ে আসে নিজেদের ভেতরের মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তোলার। মানুষের ভেতরের মানবিকবোধের চেয়ে মহৎ কিছু কি আছে পৃথিবীতে?
মানবসেবার মাধ্যমেই আমরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারি। তাই করোনাভাইরাসের ভয় না ছড়িয়ে দুর্যোগ মুকাবিলা করার সুচিন্তিত ভাবনা ভাবা উচিত আমাদের। ভয়কে জয় করতে হবে আমাদের। অনর্থক ভয়ে যারা ভীত হচ্ছে তাদের শান্ত করাও সুস্থ সুশীল মানুষের কর্তব্য।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া ইকরা বাংলাদেশ।