সকাল নারায়ণগঞ্জঃ
শ্রম আইনের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারাসমূহ বাতিল করে গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন কর।
গণতান্ত্রিক শ্রম আইনের প্রত্যাশা, শ্রম আইন সংশোধন ও শ্রমিক আন্দোলন’ শীর্ষক মতবিনিময়সভা সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার উদ্যোগে আজ বিকাল ৩ টায় ২ নং রেল গেটস্থ সংগঠনের জেলা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি আবু নাঈম খান বিপ্লবের সভাপতিত্বে মতবিনিময়সভায় বক্তব্য রাখেন শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ-স্কপের অন্যতম শীর্ষ নেতা সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক বিমল কান্তি দাস, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের জেলার সভাপতি সেলিম মাহমুদ, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি দুলাল সাহা, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি এম এ শাহীন, প্রগতি লেখক সংঘের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি জাকির হোসেন, সমাজ অনুশীলন কেন্দ্রের সংগঠক কবি রঘু অভিজিত রায়, রি-রোলিং স্টিল মিলস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক এস এম কাদির।
রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, যে কোন সমাজ পরিচালিত হয় নীতি দ্বারা আর আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর যে কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয় আইন দ্বারা। রাজতন্ত্রে রাজা আইন তৈরি করতেন, প্রয়োগ করতেন এবং আইন অনুযায়ী বিচার করতেন অর্থাৎ সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল রাজার হাতে।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর বলা হল আইন প্রণীত হবে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী। কোন একটা দেশের আইন দেখে যেমন বুঝতে পারা যায় সে দেশের আইনে জনগণের ইচ্ছার কতখানি প্রতিফলন ঘটেছে এবং সাধারণ মানুষের অধিকার কতখানি সুরক্ষিত করা হয়েছে।
গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাপকাঠিতে বলতে হবে আইনটি গনতান্ত্রিক কি না। শ্রম আইনের ক্ষেত্রেও বলা হবে যে শ্রম আইন শ্রমজীবীদের স্বার্থরক্ষা করে কিনা। গণতান্ত্রিক শ্রম আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে এই যে, শ্রম আইনে শ্রমিকের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্থাৎ সংগঠিত হওয়ার অধিকার, জীবিকার নিশ্চয়তার অধিকার, মানসম্পন্ন জীবন যাপনের অধিকার, বৈষম্যহীন ও মর্যাদাপূর্ণ কর্ম পরিবেশ, কর্মক্ষেত্রে নিহত আহত হলে যুক্তিসঙ্গত ক্ষতিপূরণ, অবসরকালীন জীবনযাপনের নিশ্চয়তা সুরক্ষিত থাকবে। এই মানদÐের ভিত্তিতেই দেখতে হবে শ্রম আইন গণতান্ত্রিক হয়েছে কিনা।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে অতীত থেকে বিরাজমান ২৫ টি আইনকে একত্রিত করে ২০২৬ সালে ৩৫৪ টি ধারা এবং ২১ টি অধ্যায় সম্বলিত বাংলাদেশ শ্রম আইন প্রবর্তন করা হয়। যে প্রক্রিয়ায় শ্রম আইন প্রণয়ন করা হয় আর যে প্রক্রিয়ায় সংসদে আইন পাশ করা হয়েছিল তা কোনভাবেই গনতান্ত্রিক ছিল না।
ফলে শ্রম আইন সংসদে পাশ করার পর থেকেই আইন সংশোধনের দাবি উঠতে থাকে শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। ফলশ্রæতিতে ২০০৯, ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় এই যে, প্রতিবার শ্রম আইন সংশোধনের সময় দুই একটি ধারায় শ্রমিক স্বার্থের কিছুটা অগ্রগতি হলেও আইনের মারপ্যাঁচে অন্য ধারায় অধিকার সংকুচিত করে ফেলা হয়। ফলে প্রতি বার শ্রম আইন সংশোধনের পর আবার সংশোধনের দাবি উঠতে থাকে।
এই প্রেক্ষিতে ২০২২ সালে আবার শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলে শ্রম আইন গনতান্ত্রিক করার লক্ষ্যে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এর পক্ষ থেকে প্রস্তাব প্রদান করা হয়েছিল। আমাদের পক্ষ থেকে প্রধানত শ্রমিকের সংজ্ঞা, শ্রম আইনের আওতা, দেশের সকল শ্রমিক একই আইনের আওতায় আনা, কর্ম ঘণ্টা সুনির্দিষ্ট করা ও ৮ ঘণ্টা রাখা, প্রসূতিদের ক্ষেত্রে আইনে অধিকারের বৈষম্য দূর করা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহতদের ক্ষতিপূরণ পুনর্নির্ধারণ করা, আহতদের পুনর্বাসন, কর্মক্ষেত্র থেকে শ্রমিকদের কর্মচ্যুত করার অন্যায্য আইন বাতিল করার প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আইএলও এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষণসমুহকে গুরুত্ব দিয়ে আইএলও কনভেনশন ৮১, ৮৭ এবং ৯৮ নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়।
সে অনুযায়ী আমাদের আলোচনা সীমিত এবং নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে। শ্রম আইনের ৩৫৪ টি ধারার মধ্যে ১৯৪ টি ধারায় ২১৪ টি প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। ১৫ টি বৈঠকের পর ৮৮ টি প্রস্তাব গৃহীত হয়, ৭৪ টি প্রস্তাব বাদ দেয়া হয় এবং ৫৩ টি প্রস্তাব একমত হওয়া যায়নি বলে উচ্চতর কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। ফলে বর্তমানের শ্রম আইন সংশোধনেও শ্রমিকদের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত হবে না।
ওসমান আলী বলেন, শ্রম আইন কখনই দেশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার খর্ব করতে পারে না। ফলে বাংলাদেশের সংবিধান, আইএলও কনভেনশন এবং সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার আলোকেই শ্রম আইন প্রণয়ন করা উচিত।
কিন্তু দ্ব›দ্ব যেহেতু শ্রম এবং পুঁজির, মালিকের উদ্দেশ্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা আর শ্রমিকের লড়াই ন্যায্য মজুরির সে ক্ষেত্রে সরকারের ভুমিকা কখনই নিরপেক্ষ থাকে না। মালিকের পক্ষের সরকার মালিকদের গড় স্বার্থ রক্ষায় চেষ্টা করে ফলে আইন এবং বিচার মালিকদের পক্ষেই থাকে।
আইনের বেড়াজালে শ্রমিকদেরকে আটকে রাখা মালিকদের উদ্দেশ্য তাই তাঁরা তাদের পক্ষেই আইন প্রণয়ন করতে চায়। অন্যদিকে ট্রেড ইউনিয়ন হলো লক্ষ কোটি শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার। তাই ট্রেড ইউনিয়নকে শ্রমিকের পক্ষে কাজে লাগাতে হলে শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনের বিকল্প নাই। শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শ্রমিক খুজে নেবে সঠিক সংগঠন এবং প্রতিহত করবে সমস্ত ধরনের চক্রান্ত।
নেতৃবৃন্দ শ্রম আইনের ১৩, ২০, ২৩, ২৬, ২৭, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ১৭৯, ১৮০ ধারাসহ সকল শ্রমিক স্বার্থবিরোধী আইন সংশোধন করে গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়নের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহŸান জানান।