সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর মাধ্যমে উপমহাদেশে ব্রিটিশরা নিজেদের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। দীর্ঘ ৮০০ বছর ভারত শাসনকারী মুসলিমদের অস্তিত্ব বিনাশের লক্ষ্যে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল বেনিয়ারা।
রাজ্যহারা মুসলমান যেন ইমানহারা না হয়ে যায়, সে জন্য পরে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে গঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ। এভাবে ভারতবর্ষ মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে দেওবন্দকেন্দ্রিক শুধু ধর্মীয় শিক্ষা, অন্যদিকে স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা। যেটিকে অনেকে দুনিয়াবী শিক্ষা বলে আখ্যায়িত করেন।
এভাবে মুসলমানদের মধ্যে গড়ে ওঠে দ্বীনি ও দুনিয়াবি শিক্ষার বিভাজন। অথচ রাসূল (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে ইসলামের সোনালি যুগে ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষা নামে আলাদা কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
ব্রিটিশদের এ কূটচালের ফসল হিসেবে এখন মুসলিমদের অবস্থা এমন যে, যারা ধর্ম বোঝে তারা কর্ম বোঝে না, আর যারা কর্ম বোঝে তারা ধর্ম জানে না। বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) আফসোস করে বলেছিলেন, ‘ধর্মহীন কর্মশিক্ষা আর কর্মহীন ধর্মশিক্ষা উভয়টি জাতির জন্য অভিশাপ’।
এ বছরের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব টঙ্গী ময়দান সরেজমিন পরিদর্শন করে আমার এমন আশঙ্কাই জাগ্রত হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি বাড়িয়ে দিতে বিশ্ব ইজতেমাকে কেউ পরিকল্পিতভাবে ভাগ করেনি তো?
ইজতেমা শুরুর একদিন আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন ময়দানে যাই, তখন প্রায় ময়দানই ভরে গেছে। তখনও অনেকে আসছেন, আমি দাঁড়িয়ে আগত প্রায় সবাইকে দেখার চেষ্টা করেছি। গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষিত ও স্কুল-কলেজের কিছু ছাত্রও ময়দানে ঢুকছিলেন।
একবারে বাঙালি মুসলমান। দ্বীন-ধর্মের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিল না, তাবলিগ জামাতের কল্যাণে দ্বীনের পথে এসেছেন। এক সময় এমন ভোলাভালা মুসলমানদের পূর্ণ ইসলামের ওপর পরিচালিত করতেই হজরতজি ইলিয়াস (রহ.) তাবলিগের এ মেহনত শুরু করেছিলেন।
তাবলিগের মেহনত মূলত আল্লাহভোলা বান্দাদের আল্লাহর হুকুমের ওপর নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। বিগত ১০০ বছরে এ ধারার মেহনতের ফল গোটাবিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে আবার পুরো ময়দান হেঁটেছি, গত ১০ বছরে এটিই হয়তো আমার প্রথম পুরো ময়দান হাঁটা। স্বাভাবিকভাবে পুরো ময়দান তখনই ভরে গিয়েছিল। প্রথম পর্বের মতো তেমন ভিড় ও কোলাহল ছিল না। তবে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের আনাগোনায় মুখোর হয়ে উঠেছিল তুরাগ তীর।
ইজতেমার প্রথম পর্বে যেখানে তাবলিগি সাথীদের চেয়ে অনেকটা মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রাধান্য ছিল, সে হিসেবে দ্বিতীয় পর্বে পুরোটাই ছিল তাবলিগের সাথীদের মজমা। এ কথাটি সবাই স্বীকার করবে যে, প্রথম পর্বে মাদ্রাসার ছাত্র ও আলেমদের আধিক্য ছিল, আর দ্বিতীয়টি ছিল পূর্ণ তাবলিগের ইজতেমা। এটিই আমাদের ভয় ও আফসোসের কারণ।
বিশ্ব ইজতেমাকে কেন এভাবে বিভক্ত করা হল, আমরা সে প্রশ্নটিই গভীরভাবে ভাবার চেষ্টা করেছি। এ বিভক্তির দায় কার? একটি সম্প্রদায়কে কারা সম্পূর্ণ আলাদা করে দিল? মসজিদ থেকে বের করে দেয়া, সামাজিকভাবে বয়কট এগুলো কি সুস্থ আচরণ ছিল?
যদি তাবলিগের এ বিশাল জনগোষ্ঠী গোমরাহও হয়ে যায়, তবুও আলেমদের দায়িত্ব ছিল এদের সঙ্গে রাখা, কারণ তাদের দ্বীন শেখানোর দায়িত্ব আলেমদেরই। কিন্তু না, ফতোয়া দিয়ে তাদের আলাদা করা হল। বিভিন্ন হিংসাত্মক কথায় জর্জরিত করা হল সাধারণ সাথীদের।
আখেরে ফল দাঁড়াল কী? চরম প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেই সাধারণ মানুষ নিজেরা সংগঠিত হয়েছে। আলাদাভাবে ইজতেমার মধ্য দিয়ে তাবলিগের দু’পক্ষের মনোবলই বৃদ্ধি পেয়েছে। একপক্ষ মনে করছেন, আমাদের সঙ্গে তো দেশের আলেমরা আছেন, আমরা আরও এগিয়ে যাব।
অপরপক্ষের মনোভাব, মাঠের সাথীরা আমাদের সঙ্গে রয়েছে, এবারের ইজতেমায় তা প্রমাণিত। সুতরাং আমরা আরও সংগঠিত হব। কিন্তু উভয়পক্ষ একবারও ভাবছেন না, আসলে মেহনতের কতটুকু লাভ হল।
ইজতেমায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথম পর্বেও ছিলেন এমন কয়েকজন পুরনো মুবাল্লিগের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রায় সবারই অভিন্ন মত যে, দ্বিতীয় পর্বের বয়ানে তাবলিগের সেই পুরনো ধারার বয়ান তারা ফিরে পেয়েছেন। যেখানে প্রথম পর্বের বয়ানে তাবলিগের চিরায়ত ধারার বাইরে অনেকে বয়ান করেছেন। ইশারায় প্রতিপক্ষকে ইঙ্গিত করেও অনেকে কথা বলেছেন।
তাবলিগ জামাতের সদর দফতর দিল্লির নিজামুদ্দিন মার্কাজ থেকে এবার ৩২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ইজতেমায় এসেছিল। আমাদের পরিচিত এক আলেম, যিনি উভয়পক্ষকে মেলানোর ফিকিরে ছিলেন শুরু থেকেই, মুরব্বিদের সঙ্গে তিনি বারবার কথা বলেছেন। আলাদা ইজতেমাই যে একমাত্র সমাধান নয়, বিষয়টি নিজামুদ্দিনের মুরব্বিদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেমন সাড়া পেয়েছেন? তিনি জানালেন, এক হয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা মুরব্বিরাও অনুভব করেন, তবে এর পন্থা নিয়ে তাদের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। শীর্ষ দু-একজন মুরব্বির ভাষ্য এমন, যারা মার্কাজ থেকে বেরিয়ে গেছে তারা ফিরে এলেই তো সমাধান হয়ে যায়। আমাদের কী করার আছে? আবার কয়েকজন চান, যারা বেরিয়ে গেছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফিরিয়ে আনার মধ্যেই উভয় পক্ষের কল্যাণ।
ইজতেমা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কাদা ছোড়াছুড়ি ছিল সবচেয়ে দুঃখজনক একটি বিষয়। নিজেদের ইজতেমার বড়ত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষকে যে ভাষায় ঘায়েল করা হয়েছে, তা দেখে সাধারণ মানুষই লজ্জা পেয়েছে। অনেক বড় আলেমও দেখলাম, অহেতুক এমন ভিডিও নিয়মিত শেয়ার করেছেন।
গত এক মাস ধরে আমাদের দেশের নবীর ওয়ারিসরা যে ব্যবহার দেখিয়েছেন, বিশ্বের ইতিহাসে তা এক নতুন সংযোজন। আখলাকে হাসানাহ, সদাচরণ, প্রতিপক্ষের প্রতি দরদি মনোভাব, উদারতা, সম্প্রীতির যে নতুন নজির আমাদের মাদ্রাসাপড়ুয়ারা স্থাপন করেছেন, এসব পরিভাষার সংজ্ঞা বদলে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে!
ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব বিদেশি মেহমানদের অংশগ্রহণ আগেরবারের চেয়েও অনেক বেশিই ছিল। তবুও বিদেশি খিমায় তেমন প্রাণচাঞ্চল্য ছিল না। গুমোট একটি ভাব বিরাজ করছিল সর্বত্রই। ইজতেমার প্রথম পর্বে গিয়ে মনে হয়েছিল, বিভক্তির কারণে তাবলিগ জামাতের গলা চেপে ধরা হয়েছে, দ্বিতীয় পর্বে মনে হল গলা চেপে ধরার কারণে এ মেহনতের প্রাণবায়ুই বের হওয়ার পথে।
লেখক : ধর্ম দরদি ও প্রাবন্ধিক