গ্যাস সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে নারায়ণগঞ্জে। দিনে রাতে কোনো সময়ই গ্যাস থাকছে না।
বিকল্প পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেই বিকল্প পদ্ধতির পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা।
এদিকে বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সঙ্কট নিরসনের দাবিতে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান।
জানা গেছে, গত কিছুদিন ধরেই নারায়ণগঞ্জের শহর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকায় চরম গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
আগে গ্যাস সঙ্কটের সময়ে রাতের বেলায় গ্যাসের দেখা মিললেওেএখন দিনে রাতে কখনোই দেখা মিলছে না গ্যাসের। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের চাষাঢ়া, বাগে জান্নাত, মিশনপাড়া, খানপুর, মেট্টো হল, তল্লা, বাবুরাইল, পাক্কারোড, দেওভোগ আখড়া, পালপাড়া, ভূইয়ারবাগ, নন্দীপাড়া, আমলাপাড়া, গলাচিপা, কলেজ রোড, জামতলা, মাসদাইর, ফতুল্লা স্টেডিয়াম-সংলগ্ন রামারবাগ, লামাপাড়া, নন্দলালপুর, দেলপাড়া, ভুঁইগড়, কাশীপুর, দোওভোগ মাদরাসা এলাকা, ফতুল্লার নরসিংহপুর, সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজিসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাসের সংকট।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পূর্ণ বিল পরিশোধ করেও পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। আগে দিনের বেলায় গ্যাস না থাকলেও রাতের বেলায় গ্যাস পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে দিনে রাতে কখনোই গ্যাসের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেকে ভীষণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। আর উপায় না দেখে অনেকে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মাটির চুলো কিংবা স্টোভ দিয়ে রান্নার কাজ করছেন। অনেকেই আবার ইলেকট্রিক চুলা কিংবা গ্যাস সিলিন্ডার কিনছেন। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব পণ্যের দামও বাড়িয়ে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
শহরের চাষাঢ়া বাগে জান্নাত এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান জানান, গত ৫ দিন ধরে তাদের এলাকায় গ্যাস নেই। আগে সঙ্কটের সময়ে রাতের বেলায় গ্যাসের দেখা মিললেও বর্তমানে দিনে রাতে কখনোই গ্যাসের দেখা মিলছে না। যে কারণে তাদের এলাকায় কেউ মাটির চুলা কিংবা স্টোভ কিনে আনছেন। আবার কেউ ইলেকট্রিক চুলা কিংবা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন। এতে করে তাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
মাসদাইর এলাকার গৃহিনী নূরজাহান বেগম জানান, গ্যাস না থাকায় স্টোভ কিনে এনেছেন। আগে যে স্টোভ বিক্রি হতো ২৫০ টাকায় সেটা বর্তমানে ৩৫০ টাকায় কিনে আনতে হয়েছে। ইলেকট্রিক বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়েছে।
লামাপাড়া এলাকার গার্মেন্টকর্মী সুমা বেগম জানান, গ্যাস না থাকায় সকালের নাস্তা দোকান থেকে কিনে খেতে হয়। অনেক সময় না খেয়েই কাজে যাই। দুপুরে ও রাতেও বাইরে থেকে কিনে খেতে হচ্ছে।
সিদ্ধিরগঞ্জ মিজমিজি এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, তাদের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস নেই। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস অফিসে লিখিত আবেদন দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। অথচ তাদেরকে গ্যাসের বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে।
এদিকে শুধু আবাসিক নয়, শিল্পকারখানাতেও বিরাজ করছে গ্যাস সঙ্কট। অনেক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেক কারখানা উৎপাদন বন্ধও রেখেছেন। নারায়ণগঞ্জের শিল্প কারখানাগুলো চালু রাখার জন্য প্রায় ১০০টি ক্যাপটিভ পাওয়ার রয়েছে, যা গ্যাস সঙ্কটের কারণে দিনের বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকছে। ক্যাপটিভ পাওয়ারগুলো বন্ধ থাকায় চরম সঙ্কটে পড়ে যাচ্ছে পুরো পোশাক খাত। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও তিতাস গ্যাস অফিসে লিখিত আবেদন দাখিল করেছেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর পরিচালক ও হাজী হাসেম স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান এম সোলায়মান জানান, বৃহদাকার শিল্পকারখানাগুলোতে ডিপিডিসির বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায় না। কারণ ডিপিডিসির বিদ্যুতের ভোল্টেজ আপ-ডাউন হয়। এর কারণে অত্যাধুনিক মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বেশিরভাগ শিল্পকারখানায় ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। গত কিছুদিন ধরে গ্যাস সরবরাহ একেবারেই নেই। আমাদের যে পরিমাণ গ্যাস দরকার সেটা পাচ্ছি না। এতে উৎপাদন বন্ধ, আমরা ক্ষতির মধ্যে আছি। এভাবে চলতে থাকলে চরম সঙ্কটে পড়ে যাবে শিল্প কারখানাগুলো। বিশেষ করে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কারখানা চালাচ্ছেন, তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি রফতানি সেক্টরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে অনেক স্পিনিং মিল শ্রমিকদের বেতন দিতে ব্যর্থ হবে। এ সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে হবে। নতুবা সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই নারায়ণগঞ্জে গ্যাস সঙ্কট নিরসনের দাবিতে তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক অফিসে চিঠি দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান।
নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী শাকির আহমেদ জানান, বর্তমানে আমাদের যে পরিমান গ্যাসের চাহিদা সে পরিমান গ্যাসের সাপ্লাই আমরা দিতে পারছি না। নারায়ণগঞ্জে আমাদের যে চাহিদা তার অর্ধেকেও বর্তমানে সরবরাহ নেই। বরং দিন দিন সরবরাহের পরিমাণ কমছে। যে কারণে একের পর এক বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস থাকছে না। গ্যাস সঙ্কট নিরসনের দাবিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তার প্যাডে আমাদের কাছে চিঠি দিয়েছেন। আমাদের এই সংকটটা যে শুধু নারায়ণগঞ্জে তা কিন্তু নয়। এটা সারা দেশেই চলছে। আমি যে এলাকায় বাস করি, সেখানেও গ্যাস নেই। এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। ওই যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম যেমন বেড়েছে তেমনি আমদানিকৃত জ্বালানিও চাহিদা মোতাবেক পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন। যদি এটা চালু হয়ে যায় তাহলে গ্যাস চালিত যে পাওয়ার প্লান্ট আছে সেগুলোর ওপর চাপ কমবে। এর আগেও বেশ কিছু গ্যাস ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে পাওয়ার প্লান্ট চালু হয়েছে। এতে আমরা আশা করছি গ্যাস ডিজেলের ওপর চাপ কমবে। চলতি মাসের শেষের দিকে সরকারের আমদানি করা জ্বালানি পাইপলাইনে ঢুকবে বলে জানতে পেরেছি। তখন গ্যাসের সরবরাহ আরো বাড়বে।
দুর্ভোগে পড়া নারায়ণগঞ্জবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি