সকাল নারায়ণগঞ্জঃ
স্টাফ রিপোর্টার (আশিক):
পুলিশের ধাওয়ায় পরিত্যক্ত ডোবায় ঝাপিয়ে পড়েন যুবক নিলয় আহমেদ (৩১)। ঘটনার তিনদিন পর ওই ডোবা থেকে মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর এমনই অভিযোগ করেন নিহতের পরিবারের লোকজন। স্থানীয় লোকজনও জানাচ্ছিলেন এমনই তথ্য। তবে এই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার এজাহারে নেই পুলিশের ধাওয়ার বিষয়টি। মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলরকে। একই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা রওশন ফেরদৌসকে থানা থেকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করা হলেও মামলায় নেই তার নাম।
মামলার আসামিরা হলেন, সাবেক সাংসদের ছেলে ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) এর ২৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাউছার আশা (৩৮), নিহতের প্রতিবেশী আমিনুল (৫৫), হাসিনা বেগম (৪৫), শিপলু (৩২), আফজাল (২২), জিপু (২৬), শহিদুল ইসলাম ওরফে শইক্কা (৫০), সিরাজুল ইসলাম (৪৫), হাসান (২৬) ও সোবহান (৩৫)।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বন্দর ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক রেজাউল করিম বলেন, হত্যা মামলায় ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। হাসিনা ও সোবহান এই মামলায় গ্রেফতার আছেন। সোবহানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয় লোকজন জানান, হাসিনা বেগম (৪৫) নামে প্রতিবেশী এক নারীর সাথে দ্বন্দ্ব ছিল নিহত যুবক নিলয় আহমেদ ওরফে বাবুর। বাড়িতে অসামাজিক কার্যকলাপ পরিচালনা করেন এমন অভিযোগে স্থানীয় কয়েকজনকে সাথে নিয়ে হাসিনা বেগমকে জিম্মি করে টাকা আদায় করেন নিলয়। রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ওই নারী স্থানীয় পঞ্চায়েত ও কাউন্সিলরের কাছে বিচার দিয়ে সমাধান না পেয়ে পুলিশের কাছে যান। হাসিনা বেগমের সাথে সখ্যতা থাকায় মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে নিলয়ের বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালান বন্দর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রওশন ফেরদৌস। সর্বশেষ গত ১ মে রাতে বন্দরের বাগবাড়ি এলাকায় ফোর্স নিয়ে যান ওই এসআই। পুলিশের ধাওয়ায় নিজ বাড়ির অদূরে একটি পরিত্যক্ত পুকুরে ঝাপিয়ে পড়েন নিলয়। গত বুধবার (৪ মে) দুপুরে ওই ডোবা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুই স্থানীয় বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা যায়, নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ঘটনার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইজিবাইকে একদল পুলিশ আসে। তাদের মধ্যে সাদা পোশাকে ছিলেন এসআই ফেরদৌস। তবে তার কোমরে পিস্তল ও হাতকড়া ছিল। বাকি দু’জন পুলিশ সদস্য পোশাক পরা ছিলেন এবং হাতে ছিল রাইফেল। তাদের সাথে হাসিনা বেগম নামে ওই নারীও ছিলেন। পুলিশ এসেই জনৈক সাইদুলের টিনসেডের ভাড়াবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানেই অবস্থান করছিল নিলয়। পুলিশের ধাওয়ায় পাশের পরিত্যক্ত ডোবায় ঝাপ দেয় নিলয়। তাকে উপরে তোলার জন্য ডোবায় ঢিল ছোড়েন এসআই রওশন ফেরদৌস ও স্থানীয় কয়েকজন। তবে নিলয়কে আর উপরে উঠতে দেখা যায়নি। ততক্ষণে এলাকায় মানুষজনের ভিড় জমে যায়। তাদের ধমক দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে দেন এসআই ফেরদৌস। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, নিলয় ডোবা থেকে উঠে পালিয়ে গেছে। তবে তাকে দ্রুতই গ্রেফতার করা হবে।
বাগবাড়ি পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আক্তার হোসেন বলেন, ‘পুলিশের ধাওয়াতেই ডোবায় ঝাপিয়ে পড়ে বাবু। তখন এলাকাবাসীও ঘটনাস্থলে জড়ো হয়েছিল। পুলিশকে নিয়ে এসেছিল হাসিনা। হাসিনার কাছ থেকে বাবু টাকা খেয়েছিল বলে শুনেছি। সেইটা নিয়ে থানায় অভিযোগ দিছিল সে।’
এই বিষয়ে অভিযুক্ত এসআই রওশন ফেরদৌসের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসপি’র কার্যালয়ে আছেন, কথা বলতে পারবেন না।
সোবা মিয়ার ছেলে নিলয় কাজ করতেন হোসিয়ারি কারখানায়। থাকতেন নানা বাড়িতে।
বৃৃহস্পতিবার (৫ মে) সকালে বাগবাড়ি এলাকায় মা লিলি বেগম বলেন, গত ৩০ এপ্রিল দুপুরে ও রাতে পরপর দুইবার এসআই ফেরদৌস ফোর্স নিয়ে নিলয়ের খোঁজে বাড়িতে আসেন। দুইবারই পুলিশের পোশাক পরে আসেন তারা। ১ মে রাতে তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে ডোবায় ঝাপিয়ে নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পেয়ে বাড়িতে ফিরে অনেক রাত খোঁজাখুজি করেও ছেলেকে পাননি। এ নিয়ে ২ মে থানায় জিডিও করেন। পরে ৪ মে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের ডেকে এনে খোঁজার পর ছেলের মরদেহ পান।
তবে মামলায় পুলিশের ধাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেননি লিলি বেগম। এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ধাওয়া পুলিশ দিয়ে বলে শুনেছিলাম। পরে শুনলাম কাউন্সিলরের লোকজন ধাওয়া দিয়া পানিতে নামাইছে তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিছি।’
এই বিষয়ে জানতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আবুল কাউছার সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি নিলয় হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি। তিনি সংবাদকে বলেন, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তাকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর দুলাল প্রধান। নিহত নিলয় তার আত্মীয়।
কাউন্সিলর আবুল কাউছার বলেন, ‘হাসিনা বেগম অভিযোগ নিয়ে আসলে আমি তাকে থানায় যেতে বলি। এই ঘটনায় আমার তো সম্পৃক্ততা নেই। পুলিশের ধাওয়ায় ডোবায় ঝাপিয়ে পড়ে মারা গেছে ওই যুবক। অযথ ওই পুলিশ কর্র্মকর্তাকেই এই মামলায় আসামি করা হয়নি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত নিলয়ের খালাতো বোনের স্বামী সুমন প্রধান সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল প্রধানের চাচাতো ভাই। নিলয় দুলাল প্রধানের কর্মী ছিলেন। তবে এই বিষয়ে দুলাল প্রধানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
মামলার বিষয়ে বন্দর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মোহসীন বলেন, বাদী এজাহারে যে অভিযোগ করেছেন সেই হিসেবে মামলা নেওয়া হয়েছে। মামলায় পুলিশ ধাওয়া দিছে এসব উল্লেখ নেই।
এদিকে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেন, ‘যে মারা গেছে তার বিরুদ্ধে পূর্বে একাধিক মামলা ছিল। সে জেলও খেটেছে। তবে কোন ওয়ারেন্ট ছিল না। ঘটনার দিন পুলিশ দেখে ভয়ে সে ঝাপ দিছে। পুলিশ অনেকক্ষন অপেক্ষা করে দেখেন আর সে ওঠে না। তখন পুলিশ ভেবেছে অন্য দিক দিয়ে সে উঠে গেছে। পুলিশ তো আর তাকে টার্গেট করেনি। পুলিশ ধাওয়া দিছে এইরকম কোন তথ্যও মামলায় বাদী উল্লেখ করেন নাই।’