সকাল নারায়ণগঞ্জ অনলাইন ডেস্কঃ
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চেক নিয়ে নানা ধরনের জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটছে। এসব জালিয়াতির সঙ্গে কতিপয় ব্যাংক কর্মকর্তা এবং একটি প্রতারক চক্র জড়িত।
এবার জালিয়াতি বা প্রতারক চক্রের নজর পড়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের চেকের দিকে। স্বয়ং একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক নিয়ে অভিনব প্রতারণা করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদের কয়েকজন পরিচালক প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তাদের এ প্রতারণা করতে বাধ্য করেছেন।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা অনুসরণ করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে ঘটনাটি ধরা পড়েছে।
এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাঠানো এক চিঠিতে বিধিবহির্ভূতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো চেক ব্যবহার না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে চেক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের টাকা স্থানান্তর ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারে না। কারণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কারও হিসাব নেই।
ফলে অন্য কাউকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেকও দেয়া হয় না। কিন্তু তারপরও ঋণের অর্থছাড়ে বেআইনিভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেক ব্যবহার করার কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়েছে। তারা নিয়ম মেনে চেক ইস্যু করলেও এটি ব্যবহার করা হয়েছে ঋণের টাকা তুলে নেয়ার কাজে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী নতুন প্রজন্মের বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএস), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (পিএলএফএস) ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)-এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু পরিচালক প্রভাব খাটিয়ে বেআইনিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক দিয়ে ঋণ বা লিজের অর্থছাড় করতে বাধ্য করেছেন কর্মকর্তাদের।
চেকের অর্থ কয়েক হাত ঘুরে পরিচালকদের পকেটে গেছে ঋণের টাকা হিসাবে। যেগুলো পরে তারা আত্মসাৎ করেছেন। এভাবে তুলে নেয়া ঋণের অর্থ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে কোনো জামানতও নেই। ফলে ঋণের অর্থ আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লিজিং এবং ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সভাপতি ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক নিয়ে নানা ধরনের অনিয়ম হওয়ায় এখন এর ব্যবহারে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে। আগে জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত এক ব্যাংকের টাকা অন্য ব্যাংকের গ্রাহকের হিসাবে স্থানান্তর করা যেত। এ প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম হওয়ায় তা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেক শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারে। অন্য কোনো গ্রাহকের নামে সরাসরি টাকা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে না।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোয় যাদের হিসাব রয়েছে, তারাই গ্রাহক। গ্রাহকদের নামে চেক ইস্যু করে ব্যাংক। এসব চেক দিয়ে গ্রাহকরা টাকার লেনদেন করেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হিসাব খুলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সবাই হিসাব খুলতে পারে না। কেবল দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারে। এসব হিসাবের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেকবই ইস্যু করে। এসব চেক দিয়ে কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেন করা যায়।
এর বাইরে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেক ইস্যু করা যায় না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীদের বেতনভাতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেকের মাধ্যমেই পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। এসব চেক বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মচারী সমবায় ঋণদান সমিতিতে লেনদেন করতে হয়। এর বাইরে লেনদেন করা যায় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই বিধি ভঙ্গ করে আলোচ্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেআইনিভাবে তাদের ঋণগ্রহীতাদের নামে টাকা ছাড় করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে টাকা তুলে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়ে ঋণের টাকা গ্রাহকের হিসাবে বিতরণ করেছে।
সূত্র জানায়, একসঙ্গে বড় অঙ্কের টাকা দ্রুত সরানোর জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেক ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা এই প্রক্রিয়ায় মুহূর্তেই টাকা স্থানান্তর করা যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ঋণ বা লিজের অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করেছে। নয়টি চেকের মাধ্যমে প্রায় ২৭ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে, যার সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন পরিচালক।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে উজ্জ্বল মল্লিক ও সোমা ঘোষের নামে ৬৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। এই ঋণ গ্রাহকদের দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৯টি চেক। এসব চেক গ্রাহকরা এফএএস ফাইন্যান্সে জমা করে বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা স্থানান্তর করেছে।
পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও একটি চেক ব্যবহার করে ১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে জমা করে। পরে এসব অর্থ গ্রাহকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকি অর্থ ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে দেয়া হয়। ওই টাকা দিয়ে পরে এসএ এন্টারপ্রাইজের একটি ঋণ হিসাব সমন্বয় করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি ছিল ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক পিকে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। পিকে হালদার যখন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি, তখন এ ঋণটি সমন্বয় করা হয়। অর্থাৎ রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হিসেবে পিকে হালদার এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সে পিকে হালদারের বেনামে বিপুল শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। ফলে তারা পছন্দের লোকজন উচ্চ পদে বসিয়ে ঋণের মোটা অঙ্কের অর্থছাড় করাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চেক ব্যবহার করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে স্থানান্তর করা হয়। পরে এই টাকা দিয়ে এমেক্সকো নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আগের ঋণ শোধ করা হয়। যেটি পিকে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেনামি কোম্পানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফারমার্স ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে।
এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের সাবেক পরিচালক মাহবুবুল হক (বাবুল) চিশতীকে ঋণের টাকা ছাড় করাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করা হয়েছে। চেকের অর্থ প্রথমে ফার্মার্স ব্যাংকে এবং পরে তা এডিএম ডাইয়িং অ্যান্ড ফিনিশিং কোম্পানির চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে তা পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্য একটি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এভাবে আরও কয়েক দফা স্থানান্তরের পর নগদ আকারে তুলে নেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।