যুগ যুগ ধরে ধর্ম কেবল আনুষ্ঠানিকভাবেই পালিত হচ্ছে। ধর্মের গভীর আবেদন বুঝি উপেক্ষিতই হয়ে থাকলো। তাহলে ধর্মের নাম ধর্ম হল কেন? ধর্ম না হয়ে উৎসব বা আনন্দানুষ্ঠান বা শুধুই অনুষ্ঠান হলেই তো হতো। যে কোন উৎসব যেমন বাহ্যিকের সঙ্গে জড়িত, তেমনটি তো ধর্মের ক্ষেত্রে নয়।
ধর্ম অর্থ ন্যায়নীতি, সৎপথ আর শুদ্ধাচারের চর্চা। যা মনের ভেতর থেকে পরিবর্তন হয়ে আসতে হয়। কেবল উপাসনালয়ে গিয়ে বাহ্যিক কিছু নিয়মনীতি পালন করলেই ধর্ম পালন হয়ে যায় না। সোজা কথায়, ভেতর জগৎ ঠিক না করে বাহ্যিকভাবে যতই নামাজ-কালাম পড়ুক আর জশনে জুলুস করুক না কেন সে কখনই ধার্মিক হতে পারে না; সে বকধার্মিক হয়েই থাকবে।
উৎসব অর্থ আনন্দ। আনন্দের জন্য আয়োজন তাকেই উৎসব বলে। সে রকমই আজকাল আমরা ন্যায়নীতি বাদ দিয়ে কেবল ধর্ম শব্দটিকে সাইনবোর্ড বানিয়ে আনন্দানুষ্ঠান করে যাচ্ছি। এ উৎসবের নাম দিচ্ছি ধর্মানুষ্ঠান। দুঃখজনক হল, ধর্মানুষ্ঠানে ধর্মীয় খাওয়া-দাওয়া হয় কিন্তু ধর্মীয় আচার-আচরণ বজায় রাখা হয় না। অর্থাৎ ধর্মানুষ্ঠানেই অধর্মের চর্চা করা হয়।
ধর্ম তো কেবল বেহেশতের সুখ-শান্তির বর্ণনা নয়, আনন্দ, উৎসব, কান্নাকাটি কিংবা ভয়ভীতি আর জাহান্নামের শাস্তির কথার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ধর্ম হচ্ছে, ব্যক্তিগঠন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক গঠনপ্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ নাগরিক মর্যাদা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, একে-অপরের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক বজায় রাখা, শান্তিপূর্ণ একটি সমাজ ও দেশ গঠন করা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর করা, দেশ থেকে ভয়ভীতি দূর করা এ সব কিছু।
অথচ আমরা এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সহজ কিছু পন্থা অনুসরণ করে বেহেশতের অমীয় সুধা পান করার আশায় নামাজ-কালাম পড়ে বিভোর হয়ে বসে আছি। ধর্মের সঙ্গে যেন তামাশা করছি। আমরা যদি এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পালন করতাম তাহলে পরকালে নয়, দুনিয়াতেই বেহেশতি সুখ অনুভব করতাম।
দুধরনের জনগোষ্ঠী দিয়ে সমাজ পরিবর্তন অসম্ভব। এরা হচ্ছে-
১. যারা ভোগবিলাসে মত্ত।
২. যারা ধর্মান্ধতায় মত্ত।
প্রথম গোষ্ঠী ভোগের অ্যালকোহলে আর দ্বিতীয় গোষ্ঠী ধর্মের অ্যালকোহলে বুঁদ হয়ে আছে। এরা ধর্ম না জেনে ধর্মের অ্যালকোহল পান করে। তাই আজ সমাজের এ দুরবস্থা।
ধর্মচর্চা যদি কেবল মসজিদ, মন্দিরের ভেতরের বস্তু হয় তাহলে উপাসনালয়ের বাইরে এসে কেন ধর্মীয় পোশাক পরে চলতে হবে? কেন পরিচয় দিতে হবে আমি মুসলিম? আমি হিন্দু? আমি খ্রিস্টান? সমকালে ধর্মচর্চা যেহেতু মসজিদ কিংবা মন্দিরকেন্দ্রিক হয়ে গেছে, তাই ধর্মের কোনো প্রতিফলন বাইরে থাকবে কেন?
আমাদের সমাজে ধর্ম বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে, মসজিদ বানাতে হবে, নামাজ পড়তে হবে, রোজা রাখতে হবে, দিনরাত তাসবিহ গুনতে হবে, কবর জিয়ারত করতে হবে, মৃতদের মঙ্গলকামনায় দোয়া পড়তে হবে। মিলাদ এবং দান-সদকার কথা তো আছেই। এ ক্ষুদ্র কয়েকটি রীতিনীতি কায়েম করার জন্য যদি ওই আরশে আজিম থেকে ধর্ম আসা লাগে তাহলে ধর্মের বিপরীতে যেসব প্রথা বা শয়তানি কর্মকাণ্ড রয়েছে তার সঙ্গে তার মৌলিক পার্থক্য কোথায়? ধর্মের নামে যদি কেবল কতগুলো অনুষ্ঠান হয় তাহলে ওদের সঙ্গে ধর্মের তফাৎ কোথায়? ওরাও নীতির নামে অনুষ্ঠান করেন, ধর্মানুসারীরাও নীতির নামে অনুষ্ঠান করেন!
মক্কার অংশীবাদীদের সঙ্গে পয়গম্বর মোহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে বিরোধের কারণ কি শুধু কয়েকটি রীতিনীতির কারণেই ঘটেছিল? সে সময় সমাজের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে মোহাম্মদ (সা.)-এর কথায় শতশত নারী-পুরুষ কি এমনি এমনি ইসলাম কবুল করেছিল? মুসলিম নামধারীরা কিছু ধর্মের অনুষ্ঠান করছে আর তাদের অনুষ্ঠানে মোহিত হয়ে তারা দলে দলে ইসলাম কবুল করেছে, বিষয়টি কি এমনই ছিল? নাকি মহানবীর আচার-আচরণে, তার সাহাবাদের আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করেছিল?
প্রথম ইমান গ্রহণ করেছেন যিনি (হজরত খাদিজা রা.) তিনি কি কেবল হজরতের নামাজ-রোজা দেখে ইসলাম কবুল করেছিলেন? নাকি নবীজীর সহধর্মিনী হিসেবে সার্বক্ষণিক সহচারী হয়ে নবীর সততা, বিশ্বস্ততা, বদান্যতা, নৈতিকতা, সৎ গুণাবলি দেখে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন? এ চিন্তাটুকুও কি কেউ করেন? সেই ঘোরতর অন্ধকার সমাজে নবীজী কীভাবে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন তা কি আমরা অনুসরণ করি আজ?
কেবল লম্বা জুব্বা গায় দিয়ে আর লম্বা টুপি কিংবা পাগড়ি মাথায় দিয়ে মিলাদ-কিয়াম করে ‘ইসলামিক’ হওয়া যায় না। পবিত্র কালামেও বারবার নবীজির আদর্শের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আদর্শ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কেউ ‘ইসলামিক’ হতে পারেন না। ধর্ম এসেছে আদর্শিক মানুষ গড়তে, কেবল মিষ্টি খেয়ে জৌলুসপূর্ণ অনুষ্ঠান করতে নয়।
বাংলাদেশে যে হারে ধর্মানুষ্ঠান হয় সে হারে যদি মানুষ ধর্ম পালন করত তাহলে এ দেশে কোনো খারাপ লোক থাকত না। খারাপ লোকদের বিশ্বাস এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, কিছু টাকা-পয়সা মাজারে, হুজুরকে আর মিলাদ-কিয়ামে খরচ করলেই সব পাপ মুছে যাবে, জান্নাতের টিকিট হাতে এসে যাবে!
এ বিশ্বাস তৈরি করল কারা?
এ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে কতগুলো বাহ্যিক উপাসনা করলেই মানুষকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করা যায় না। আকৃষ্ট করতে হলে, ধর্মাদর্শ চর্চা ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবা হবে বাতুলতা। আমাদের পোশাক-আশাকে, চলনে-বলনে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, উঠা-বসায়, আচার-আচরণে, পরিবেশ-পরিচ্ছন্নে অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আদর্শিক হওয়া জরুরি। নামাজ-রোজার মতোই এসব গুণাবলি তথা শুদ্ধাচারকেও উপাসনা ভাবতে হবে। শুধু তাই নয়, নামাজ-রোজার মতোই এগুলোকে ফরজ বা আবশ্যিক ভাবা জরুরি। কেননা এসব কিছু নিয়েই পবিত্র কালামপাকে বর্ণিত ‘সালাত’। নামাজ না পড়লে যেমন আফসোস করতে হয় তেমনই অন্যের সঙ্গে ছোট্ট একটি অন্যায় করে ফেললেও আফসোস করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নামাজ যেমন কাজা করার বিধান আছে তেমনই ভুল কাজ করে ফেললে তারও ক্ষমা চাওয়া জরুরি।
নামাজ-রোজা আর মিলাদ-মাহফিল করে যেমন বেহেশতের আশা করি, তেমনই মন-মানসিকতা খাঁটি করলেও যে বেহেশত পাওয়া যাবে তাও মনে রাখা জরুরি।
সূরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সৎকর্ম কেবল এই নয় যে, পূর্ব-পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাবে বরং বড় সৎকাজ হচ্ছে, ইমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব নবী-রাসূলদের ওপর। আর সম্পদ ব্যয় করবে তারই মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত প্রদান করে এবং যারা কৃতপ্রতিজ্ঞা সম্পাদন করে এবং অভাব-অনটনে, রোগ-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণ করে তারাই সত্যাশ্রয়ী ও পরহেজগার’।