স্টাফ রিপোর্টার: সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া কুসংস্কার, যৌতুকপ্রথা এবং অভাব নামক দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে বাধা পড়ে এখনও সংগ্রাম করছেন বাংলার নারীরা। নির্যাতিতদের সাহস জোগানো এবং সংগ্রামীদের সম্মানিত করার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় থেকে জয়িতা অন্বেষণে জীবনযুদ্ধে হার না মানা জেলা ও সদর উপজেলা বিভাগে ০৯ জন নারীকে বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে জয়িতা ঘোষনা করেছে।
পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই নারীদের মধ্যে সদর উপজেলা বিভাগে জয়িতা নির্বাচিত হওয়া ০৪ জন নারী একই পরিবারের সদস্য। তারা হলেন মমতাজ বেগম ও তার তিন কন্যা মাকসুদা বেগম, জাকিয়া সুলতানা এবং জান্নাতুল ফেরেদৗসী ঝুনু। নিজ নিজ ক্ষেত্রে সংগ্রাম করে আজ প্রতিষ্ঠিত তারা।
রত্নগর্ভা মমতাজ বেগম:
`সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরিতে জয়িতা মনোনীত হয়েছেন মমতাজ বেগম। স্বামী মরহুম জহিরউদ্দিন মাষ্টার। ক্লাস ফাইভে থাকতে বিয়ে হয় মমতাজ বেগমের।সেই ছোট্ট মেয়ে ধীরে ধীরে ৮ সন্তানের (৬ মেয়ে ২ ছেলে) জননী হন, সেই সাথে ম্যাট্রিক পাশ করে পিটিআই করেন। নিয়োগ পান সরকারি প্রাইমারী স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা পদে। নিয়োগ পত্রটি এখনো তার বাসায় আছে। কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চা রেখে চাকরি আর করা হয়ে উঠে না তার। দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েই স্বামী মারা যান। তিনি ছেলেমেয়েদের মানুষ করা এতটা সহজ ছিল না তার জন্য। প্রতি নিয়ত তাকে করতে হয়েছে যুদ্ধ, কখনো কাছের মানুষের সাথে আবার কখনো দূরের । কিন্তু থেমে যাননি, সবগুলো ছেলেমেয়ে কে করেছেন প্রতিষ্ঠিত। মেয়েদের বিয়ে নিয়ে কখনো তিনি বিচলিত নন। তার মুখে সবসময় শুনা যায়, মেয়েই ভালো। তার বড় সন্তান (মেয়ে) সরকারী চাকুরীজীবী, ২য় সন্তান (ছেলে) ব্যবসায়ী, ৩ সন্তান (মেয়ে) সরকারী চাকুরীজীবী, ৪র্থ সন্তান (মেয়ে) উদ্যোক্তা, ৫ম সন্তান (মেয়ে) সহকারী অধ্যাপক, ৬ষ্ঠ সন্তান (মেয়ে) উদ্যোক্তা, ৭ম সন্তান (মেয়ে) সহকারী অধ্যাপক এবং ৮ম সন্তান (ছেলে) বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্যোক্তা।
অর্থনৈতিকভাবে সফল মাকসুদা বেগম:
রত্নগর্ভা মমতাজ বেগমের ৪র্থ সন্তান মাকসুদা বেগম সূচনা। একজন দায়িত্বশীল সমাজ কর্মী হিসেবে আত্ম মানবতার সেবায় আজীবন কাজ করে যেতে দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ মাকসুদা অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি অর্থনৈতিকভাবে সফল। ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এম.এস.এস সম্পন্ন করা মাকসুদার প্রত্যাশা বাংলার ঘরে ঘরে অর্থনীতিকভাবে সফল জননী গড়ে উঠুক। নারায়ণগঞ্জের বুকে শৈশব ও কৈশরকাল
কাটানো মাকসুদা বেগম সূচনা ২০১৭ সালে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষন গ্রহন করে নিজে বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও তাসমিয়া ফ্যাশন প্রতিষ্ঠা করেন। তার ইভেন্ট অ্যাক্টিভেশন টিম পুরো বাংলাদেশ জুরে সরকারি এবং বেসরকারি কোম্পানীর কার করে। এছাড়াও মংমনসিংহের ভালুকায় তিনি গড়ে তুলেছেন তাসমিয়া ফিশারি নামে একটি মৎস খামার।
সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখছেন জরিনা বেগম:
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী’ ক্যাটাগরিতে জয়িতা মনোনীত হয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌসি ঝুনু। তিনি ভুইগড় এলাকার রুপায়ন সিটি নিবাসী ডা. মোঃ তোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী এবং রত্নগর্ভা মা মমতাজ বেগম ও মরহুম জহিরউদ্দিন মাষ্টারের কন্যা। শিক্ষাজীবনে ভূগোল বিভাগে এম.এস.সি সম্পন্ন করা জান্নতুল ফেরদৌসী ঝুনু সুদীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ সুমাইয়া ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছেন। পুরো নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৩০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী সহ বিভিন্ন অফিসে স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন যেমনঃ হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস বি, সর্দি ঠান্ডা, নিউমোনিয়া/অ্যাজমা ঠান্ডা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, জল-বসন্ত, সিজলেস মামস্ রুবেলা, জরায়ু মুখে ক্যান্সার, মেনিন গোৱাল মেনিনজাইটিস। এছাড়া স্বউদ্যোগে এবং বিনা পারিশ্রমিকে সুমাইয়া ভ্যাকসিনেশন সেন্টারের ইপিআই সরকারী টীকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। সমাজ উন্নয়নে তিনি এভাবে ব্যাপক অবদান রাখছেন।
অদম্য জাকিয়া সুলতানা:
রত্নগর্ভা মা মমতাজ বেগমের ৭ম সন্তান জাকিয়া সুলতানা শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। নবম শ্রেনীতে পড়াকালীন সময়ে বাবাকে হারান জাকিয়া। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে তার মায়ের পক্ষে সংসার চালানো ছিল খুবই কষ্টের। প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান, দমে যাননি। এরপর বড় ভাইবোন ও মায়ের সহযোগীতা ও অনুপ্রেরণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাংকিং বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি (এমবিএ) অর্জন করেন। এইজন্য পরিবারের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলীর একান্ত সহযোগিতায় তিনি কর্মক্ষেত্রে সফলতা লাভ করেন। চাকুরীর পরপরই বিয়ে হয় এবং স্বামীর সহযোগিতা নিয়ে তিনি শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সফল একজন নারী। বর্তমানে ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের গণিত বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন জাকিয়া সুলতানা।