সকাল নারায়ণগঞ্জঃ
র্যাব-৪ এর অভিযানে রাজধানীর মিরপুর হতে সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রের মূলহোতা মল্লিক রেজাউল হক সেলিমসহ দুই সহযোগী গ্রেফতার ও ভূয়া পাসপোর্ট, নকল ভিসা ও দলিল দস্তাবেজ উদ্ধার। অতি সাম্প্রতিককালে মে মাসে পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের এক তরুণীর পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এর প্রেক্ষিতে র্যাব পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও একজন মহিয়সী “মা” জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে নিজে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে মেয়েকে পাচারকারীদের নিকট হতে উদ্ধারের ঘটনা প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হলে পাচারকারী চক্রের কাল্লু-সোহাগ @ কাল্লু-নাগিন সোহাগ @ মামা-ভাগিনা @ কালা-নাগিন সিন্ডিকেটের ০৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এরপরই মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা লিটন @ ডাঃ লিটন আজাদকে গ্রেফতার করে র্যব-৪। সম্প্রতি ভিন্ন কৌশলে মানব পাচারকারী চক্রের ডিজে কামরুল ও নূরনবী চক্রকে গ্রেপ্তারসহ তাদের সেইফ হাউজ ২৩ জন ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও বেশকিছু প্রতারিত এবং নির্যাতিত ভিকটিমকে র্যাব-৪ এর উদ্দ্যেগে ফেরত আনা হয়েছে।
সর্বশেষ গতকাল মধ্যরাতে অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপর বিভিন্ন দেশে প্রেরণের কথা বলে পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষত ভারতে মানব পাচার করে আসছিল এরকম এ্কটি পাচারকারী চক্রের অন্যতম তিন হোতাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল। গত বছর ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর কথা বলে জনৈক জাহাঙ্গীরকে ভারতে পচার করে দেয়া হয়। পাচার হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ভারেতর কোলকাতায় আটক থাকে জাহাঙ্গীর।
আটক অবস্থায় কোলকাতার টর্চার শেলে উক্ত ভিকটিমকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন ও মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে দেশে থাকা তার পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে উক্ত পাচারকারী চক্র। দেশে এসে ভিকটিম জাহাঙ্গীর এসে অধিনায়ক র্যাব-৪ বরাবর উক্ত মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। উক্ত অভিযোগে তিনি মানবপাচার চক্রের ফাঁদে পড়ে কিভাবে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়েছিলেন, আটক অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন, তার জীবনে ঘটে যাওয়া হৃদয় বিদারক কাহিনী ও শেষ পর্যন্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিভাবে কৌশলে দেশে ফিরে আসেন এবং উক্ত মানবপাচার চক্র সম্পর্কে চ্যাঞ্চল্যকর তথ্যাদি উল্লেখ করেন। প্রাথমিক তদন্তে উক্ত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
প্রাপ্ত তথ্য যাচাই, গোপন তদন্ত ও স্থানীয় সোর্স হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল গতরাতে রাজধানীর মিরপুর পল্লবী ও উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচার চক্রের মূল ৩ জনকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়।
গ্রেফতারকৃত মানব পাচারকারীরা হলেন, মল্লিক রেজাউল হক @ সেলিম (৬২), জেলা-ঢাকা, মোঃ বুলবুল আহমেদ মল্লিক (৫৫), জেলা- ঢাকা ও নিরঞ্জন পাল (৫১), জেলা- ঢাকা।
উক্ত অভিযানে ভূয়া পাসপোর্ট, পাসপোর্টের কপি, নকল ভিসা, আবেদনপত্র, বায়োডাটা, ছবি, মোবাইল, মোবাইল সীম একং নগদ টাকাসহ মানবপাচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জব্দ করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, পাশ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মল্লিক রেজাউল হক সেলিম (৬২) ও তার সহযোগী বুলবুল আহমেদ মল্লিক (৫৫) এবং নিরঞ্জন পাল (৫১) এই চক্রে তাদের সহযোগী হিসেবে দেশে আরো ৫-৭ জন সদস্য রয়েছে। তাছাড়া ভারতেও তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। ইতমধ্যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কোলকাতার রাজিব খান, মানিক এবং দিল্লির রবিন সিং দের নাম পাওয়া যায়। বিগত কয়েক বছর ধরে এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানব পাচারের মত অপরাধ করে আসছে।
এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদেশে গমন প্রত্যাশী নিরীহ মানুষকে টার্গেট করে। তাদেরকে অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপর বিভিন্ন দেশ যেমন-পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, রোমানিয়া, গ্রিস, ফ্রান্স এবং মালটায় উচ্চ বেতনের চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে প্রেরনের কথা বলে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে দেয়। সংশ্লিষ্ট দেশ সমূহের ভারত থেকে ভিসা পাওয়া সহজ এই কথা বুঝিয়ে তাদেরকে প্রতারিত করে এই চক্রটি ভিকটিমকে সীমান্তবর্তী দেশে বিশষত ভারতে বৈধ এবং অবৈধ পথে পাচার করে দেয়।
কিন্তু অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় ভারতে থেকে তাদের সংশ্লিষ্ট দেশ সমূহে প্রেরনের আর কোন উদ্দ্যেগ তারা গ্রহণ করে না। বরং তারা ভিকটিমদেরকে সে দেশে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ মেরে ফেলার হুমকি দেখিয়ে সেটি ভিডিও করে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করে আসছিল বলে স্বীকার করেছে।
এই চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায়, ভিকটিমদেরকে ফেনী, কুমিল্লা, নবাবগঞ্জ, শরিয়তপুর, মাদারীপুর এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে ইউরোপে উন্নত চাকরি দেওয়ার নামে বৈধ এবং অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। পাশ্ববর্তী দেশের চক্রের সদস্যরা ভিকটিমদের ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে।
পার্শ্ববর্তী দেশে উক্ত মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য রাজিব খান ও মানিক কলকাতায় এবং রবিন সিং দিল্লিতে টর্চার সেলের/সেইফহোমে ভিকটিমদের আটক রাখার মূল দায়িত্ব পালন করে থাকে। সেখানে অজ্ঞাত নামা আরও ২/৩ জন সদস্য রয়েছে। এ চক্রটি এ পর্যন্ত শতাধিক ভিকটিমকে অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রেরণের নামে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে বলে জানা যায়।