সকাল নারায়ণগঞ্জ:
স্টাফ রিপোর্টার (আশিক)
শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় দায়িত্বরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের স্মরণ করলো বাংলাদেশ পুলিশ। ২০২০ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণে পালন করা হয় ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে ২০২১’।
দেশের প্রতিটি পুলিশ ইউনিটে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানী ঢাকায় দিবসটি উদযাপন করা হয়। এছাড়া, সকল রেঞ্জ ও জেলা পর্যায়েও দিবসটি পালিত হয়। দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে ছিল পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান ইত্যাদি।
দিবসের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সোমবার (১ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০ টায় রাজধানীর মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজ বাংলাদেশ ক্যাম্পাসে নির্মিত অস্থায়ী পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি), বাংলাদেশ ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) এবং জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। একটি চৌকস পুলিশ দল গার্ড অব অনার প্রদান করে।
এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে উঠে। পরে আইজিপী ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) এর সভাপতিত্বে পিএসসি কনভেনশন হলে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার্থে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিহত হন। তারা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, তারা যেন আমাদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকেন।
কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশ সদস্যগণ আন্তরিকতা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার মতো চরম আত্মত্যাগ প্রদর্শন করে দায়িত্ব পালনের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। সেজন্য পুলিশ বাহিনীসহ সারাদেশ আজ গর্বিত।
তিনি বলেন, শুধু দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নয়, করোনাকালেও পুলিশ মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হচ্ছি আমরা। উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ত যদি নিরাপত্তা বিধান করা না যেত। পুলিশ বাহিনীর ওপর অর্পিত দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করছে বলেই দেশ নিরাপদ রয়েছে।
সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন বলেন, ২০১৯ সালে দায়িত্ব পালনকালে ১৭৯ জন পুলিশ সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, ২০২০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ালো ২০৮। আমরা এ ধরনের অকাল মৃত্যু, অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার চেষ্টা করবো। আমরা চাইবো কারো জন্য অকাল মৃত্যু না হয়, অস্বাভাবিক মৃত্যু না হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ এখন যে কোন সংকট মোকাবেলায় সক্ষম।
মানবিক পুলিশ হিসেবেও পুলিশ বাহিনী ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। মানুষ যখন কোন সমস্যায় পড়ে তখনই পুলিশের শরণাপন্ন হয়। তাই আমরা বলি, পুলিশ হবে মানবিক, পুলিশ হবে জনতার। করোনা মহামারীকালে পুলিশ যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে, তা সত্যিই বিরল।
তিনি বলেন, এ দেশের জনগণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সহানুভূতি নিয়ে কাজ করার এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। বলেন, পুলিশ যে কোন সংকটে নির্ভিক চিত্তে আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে বলেই দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় আছে, দেশের উন্নতি হচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) দেশমাতৃকার জন্য, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় গণমানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, দায়িত্বরত অবস্থায় প্রতি বছর আমরা আমাদের অনেক সহকর্মীকে হারাই। আমরা আমাদের কোন সহকর্মীকে হারাতে চাই না। কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও পেশাগত তাগিদে পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতে হয়।
এ আত্মত্যাগ অত্যন্ত দুঃসহ। করোনাকালেও আমরা আমাদের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৮৬ জন সদস্যকে হারিয়েছি। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ পুলিশ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আইজিপি বলেন, নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনীয় সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করেছেন। নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গের উদ্দেশ্যে আইজিপি বলেন, জীবনের কোন বিনিময় মূল্য হতে পারে না। আপনারা আপনজন হারিয়েছেন, আপনাদের ক্ষতি অপূরণীয়।
পুলিশ একটি পরিবার। আপনাদের খোঁজ-খবর রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের সীমিত সামর্থের মধ্য দিয়ে আমরা এ দায়িত্ব পালন করছি। আইজিপি জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের নামে পুলিশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ করা হবে বলে অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে ‘মেমোরিয়াল ডে’ পালিত হয়।
আবার পুলিশের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততাকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘ব্লু রিবন ডে’ উদযাপন করা হয়। এদিন জনগণ পুলিশের সাথে তাদের সংহতি প্রকাশ করে। পুলিশের সাথে জনগণের শ্রদ্ধার, ভালবাসার যে সম্পর্ক রয়েছে তা দিনটিতে প্রতিভাত হয়। তিনি ‘ব্লু রিবন ডে’ পালনের অনুমতি প্রদানের জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান।
দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, আইন-শৃঙ্খলা ও জনগণের জানমাল রক্ষার মত ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে ২০২০ সালে দায়িত্বরত অবস্থায় ২০৮ জন পুলিশ সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। অনুষ্ঠানে তাদের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব এবং আইজিপি মঞ্চ থেকে দর্শক সারিতে এসে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের স্বজনদেরকে স্বীকৃতি স্মারক ও উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। এসময় তাদের পরিবারবর্গ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তখন এক শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়।
নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ক্রেস্ট, সনদপত্র, নগদ অর্থ এবং উপহার সামগ্রী দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত এবং তাদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত আইজি (এইচআরএম) মোঃ মাজহারুল ইসলাম। বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিগণ, ঢাকাস্থ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধানগণ, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর ১ মার্চ দায়িত্বরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের স্মরণে ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে’ পালন করা হচ্ছে।