সকাল নারায়ণগঞ্জঃ
২১ শে ফেব্রুয়ারি১৯৫২,রোজ বৃহস্পতিবার, ঢাকার বাহিরে বাংগালীদে প্রথম প্রতিবাদ মিশিল, এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আমাদের পারিবারিক স্মৃতিঃ-
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে আমার পিতার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে স্ফুলিঙ্গের দাবানলের মত ছড়িয়ে পরা প্রতিবাদ মুখর নারায়নগঞ্জের কিছু ঘটনা (আমার পারিবারিক স্মৃতি চারন)
২১শে ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা দিবসের প্রাক্কালে আমি আমাদের কিছু পারিবারিক স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আর এই জন্যে চাই যেন প্রায় ৬৯ বসর আগে ঠিক ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে আমাদের প্রিয় নারায়নগঞ্জে কি ঘটেছিলো তার কিছু চিত্র আপনারা উপলব্ধি করতে পারবেন এবং যা কিনা ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষনে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।
২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল, এই দিনটি ছিল আমার পিতা মরহুম গোলাম রব্বানি খানের বিয়ের পুর্বদিন অর্থাৎ গায়ে হলুদের দিন। আমার দাদা পুর্ব বাংলা আইন পরিষদের সদস্য (যিনি ব্যাক্তিজীবনে শেরে বাংলা ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন) মরহুম আবদুস সামাদ খানের গলাচিপাস্থ ৪০ নং কলেজ রোডের বাড়ীতেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নারায়নগঞ্জের গণ্যমান্য সহ বহু মানুষ আমন্ত্রিত ছিলো এই অনুষ্ঠানে ।
আমার পিতা সহ তার ঘনিষ্ঠ সবাই তখন রাজনীতি ও ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। কিন্তু ২০শে ফেব্রুয়ারি যখন ভাষার দাবীতে পরিস্থিতি খুব খারাপ দিকে যাচ্ছিলো, সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকাতে ১৪৪ ধারা জারী করা হলো তখন ঐ রাতেই সিদ্ধান্ত হলো যে পরবর্তী দিন ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকাতে ১৪৪ ধারা ভেংগে রাস্ট্র ভাষার দাবীতে কর্মসূচী পালন করা হবে।
ভাষার দাবীতে দ্রুত অবনতিশীল এই পরিস্থিতিতে আমার পিতার হলুদের অনুষ্ঠান হবে কিনা, নাকি স্থগিত করা হবে এবং ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার দাবীতে নারায়নগঞ্জের কর্মসুচী কি হবে তা নির্দারনে নারায়নগঞ্জের নেতৃবৃন্দ ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতেই আমাদের কলেজ রোডের বাসভবনে মিলিত হন। ঐ বৈঠকে অন্যান্যদের সাথে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা শফি হোসেন খান, মরহুম সামসুজ্জোহা চাচা (শামিম ওসমানের পিতা), মরহুম বজলুল রহমান চাচা, আলমাস কাকা, মফিজ কাকা, মরহুম জানে আলম কাকা, লোকমান ফকির, মরহুম জালালুদ্দিন আহমেদ কাকা ( কুতুব উদ্দিন আকসিরের বড় ভাই), মরহুম বাদশা মিয়া ভাই, মরহুম মুলকুতুর রহমান কাকা, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ কাকা, শফি কাকা( প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার) সহ নারায়ণগঞ্জ এর প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিল।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যেহেতু সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ সেহেতু গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটি বহাল রেখে এর আচলেই ব্যাপক সমাগম প্রস্তুত রাখা এবং ঢাকাতে ভাষা সমাবেশে কোনো নির্যাতন হলেই সাথে সাথে এর প্রতিবাদ করা। আর ঢাকার খবর সংগ্রহ করার জন্য আমার পিতার গাড়ীর ড্রাইভার গলাচিপা ঘোড়াপারা নিবাসী মরহুম নেওয়াজ আলী পাগলকে পাঠানো হয়।
যেই পরিকল্পনা সেই অনুযায়ী কাজ। ২১ শে ফেব্রুয়ারি দুপুরের মধ্যেই অনুষ্ঠানস্থল অতিথিতে পরিপুর্ন হয়ে গেলো। নারায়ণগঞ্জ এর প্রথম সারির প্রায় সবাই উপস্থিত ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী মহিলাদের ব্যাপক সমাগম করানো হয়। উপস্থিত মহিলাদের পরনে ছিলো হলুদ রঙের শাড়ী কাপড় আর পুরুষদের ছিলো সাধা পাঞ্জাবি।
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঢাকা থেকে খবর আসলো সালাম বরকত সহ অনেককেই হত্যা করা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার কর্মসূচীর খবর সংগ্রহের জন্য পাঠানো আমার পিতার গাড়ীর ড্রাইভার ডি এন রোড নিবাসী মরহুম নেওয়াজ আলি চাচাও গুলিবিদ্ধ হয়। ঢাকার খবর পাওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেয় পুরুষেরা সবাই ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গলাচিপা রেল লাইনের পথ ধরে সোজা খান সাহেব ওসমান আলীর ( শামিম ওসমানের দাদা ) বাসভবন চাষারার বাইতুল আমানে একত্রিত হবে।
আর জোহা চাচার (শামীম ভাইয়ের আব্বা) নির্দেশে মেয়েরা সবাই গায়ে হলুদের কাপর পরেই মরগ্যান গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে মিশিল বেড় করে শহর প্রদক্ষিণ করে বাইতুল আমানে একত্রিত হবে।
যেই কথা সেই কাজ। মাতৃ ভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় আন্দোলনরত নিরিহ বাংগালী ছাত্র জনতার উপর পাকিস্তান সরকারের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে মহিলাদের নেতৃত্বে গায়ে হলুদের কাপড় পরিহিতদের এক বিশাল মিশিল আমাদের গলাচিপা বাড়ী থেকে বেরিয়ে নারায়ণগঞ্জ এর প্রত্যেকটি গুরুত্বপুর্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বাইতুল আমানে একত্রিত হয়। আর এটাই ছিলো ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সংঘঠিত ভাষা শহিদদের হত্যার প্রতিবাদে ঢাকার বাহিরে বাংগালিদের প্রথম প্রতিবাদ মিশিল।
আর এই মিশিলের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পরার সাথে সাথে ঢাকা থেকে আসা প্যারা মেলিটারি ফোর্স আমারদের গলাচিপা বাড়ীতে এসে উপস্থিতি হয় কিন্তু ততক্ষনে আমার পিতাসহ জালাল কাকা, শফি কাকা, জোহা চাচা সবাই বাইতুল আমানে অবস্থান করছিলেন ও পরবর্তি করনীয় সম্পর্কে পরিকল্পনা করছিলেল, শুধু মাত্র বিশেষ কারনে পরিকল্পনা অনুযাই ভাষা সৈনিক বাদশা মিয়া আমাদের গলাচিপা বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তখন বিশেষ ফোর্স ভাষা সৈনিক বাদশা মিয়াকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
গলাচিপাতে প্যারা মিলিটারি ফোর্সের হানা দেওয়ার খবরের সাথে সাথে বাইতুল আমানে থাকা নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার এড়াতে ও আন্দোলনকে চরম মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে ঢাকার প্যারা মিলিটারি ফোর্সের নারায়ণগঞ্জে অবস্থানকালীন সময়ের কয়েক ঘন্টার জন্যে সাময়িক আন্তগোপনে চলে যান। পরবর্তীতে খান সাহেব ওসমান আলী সহ অনেকেই খুব সম্ভবত ২৯ শে ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন। পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার হন শফি কাকা, জালাল কাকা, মমতাজ বেগম সহ অনেকে।
এদিকে গলাচিপা থেকে বিশেষ ফোর্স চাষারা বাইতুল আমানে উপস্থিত হয়ে নেতৃবৃন্দকে না পেয়ে বাড়িতে অবস্থানরত সবাইকে নির্মম নির্যাতন করে যা থেকে উপস্থিত মহিলা ও বাড়ীর শিশুরাও রক্ষা পায়নি। এই ছিলো সেই দিনের কিছু খন্ডিত ইতিহাস।